সম্পাদক ও প্রকাশকদের জন্য প্রশিক্ষণ চাই

২০০৯ সালের ৭ মে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের অধীনে যাত্রীর (জার্নালিজম ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ) সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ ও গবেষণা উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম উপলক্ষে এক অনুষ্ঠান হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বর্তমান সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। এ অনুষ্ঠানে মতিউর রহমানের দেওয়া বক্তব্যের ভিত্তিতে লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।

সাংবাদিক হতে হলে কোনো প্রশিক্ষণের দরকার আছে কি না—বাংলাদেশে সংবাদপত্রের জগতে বহুদিন এই বিতর্ক ছিল। আমরা জানি, পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে ’৭০-৭১ সাল পর্যন্ত তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির আত্মসচেতনতা এবং অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সংবাদপত্র বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এসব সংবাদপত্রের খুব অল্পসংখ্যক সাংবাদিক হয়তো দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এখনো আমাদের অনেক প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন পেশার প্রতি ভালোবাসা, নিয়মিত চর্চা, পরিশ্রম এবং প্রতিদিন কাজ শেখা। সে জন্যই হয়তো এখনো কলকাতার বড় দুই কাগজ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ও ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ কর্তৃপক্ষ সাংবাদিক বিভাগ থেকে পাস করা কোনো তরুণকে চাকরিতে নিয়োগ দিতে আগ্রহী নয়, বরং অন্য বিভাগের সেরা ছাত্রদের নিয়ে আসে তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা বিভাগ চালু রয়েছে। কিন্তু এক দশক ধরে আমরা ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ভালো ফল করা বেশ কিছু শিক্ষার্থী পাচ্ছি, যাঁরা সংবাদপত্রে কাজ করতে আসছেন। এর আগের একটা সময় পর্যন্ত তাঁরা সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ডিগ্রি নিয়ে তথ্য বা জনসংযোগ কর্মকর্তা অথবা অন্যান্য কাজে যোগ দিতেন। এক দশক ধরে সে ধারায় একটা পরিবর্তন এসেছে। সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এখন সংবাদপত্রে কাজ করতে আসছেন। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রথম দিকে যাঁরা আসতেন, তাঁরা প্রধানত বার্তাকক্ষে সম্পাদনার কাজ করতে চাইতেন। অর্থাৎ রিপোর্টিং, সম্পাদকীয়, ফিচার বিভাগ বা অন্য কোনো কাজে তাঁরা কম উত্সাহী ছিলেন। এ ক্ষেত্রে এখন পরিবর্তন এসেছে। এটা একটা বড় ও শুভ পরিবর্তন।

বিদেশি অর্থে প্রশিক্ষণ

ঢাকা শহরে পিআইবি (প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ) বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে; সেটি নামে স্বায়ত্তশাসিত, কাজে সরকারি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের যে চেহারা, যে পরিবেশ থাকে, সেখানেও তা-ই। এ প্রতিষ্ঠানটি কতটুকু জীবিত বা কতটুকু মৃত, তা বোঝা খুব কঠিন। সেখানে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা কিছু করার চেষ্টা করেন। যে প্রশিক্ষণগুলো সেখানে হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা পরিচালনার পেছনে হয় ইউনিসেফ, না হয় অন্য কোনো বিদেশি সাহায্য সংস্থার অর্থ থাকে। বিষয় তারাই নির্ধারণ করে দেয় এবং সেই ধারাতেই প্রশিক্ষণ হয়। সেগুলোতে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। কিছু অবশ্য পিআইবির নিজস্ব অর্থায়নেও হয়।

কয়েক বছর ধরে বিদেশি অর্থে পরিচালিত একাধিক এনজিও সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাতেও খুব ভালো কোনো ফল এখনো দেখতে পাইনি। আমাদের পত্রিকায় সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের জন্য এ ধরনের এনজিওর কাছ থেকে প্রস্তাব এলে খুব উত্সাহিত বোধ করতে পারি না। এসবের পেছনে দেখতে পাই সময় ও অর্থের অপচয়। আমরা জানি, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠান কখনো কখনো বড় এবং ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। সাংবাদিকদের ঢাকার বাইরে নিয়ে গিয়েও তিন-চার দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা করেছে। তাতেও তেমন ভালো কিছু হয়নি। এ ধরনের অনেক উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। এর একটা কারণ হতে পারে এই যে আমাদের সাংবাদিকেরা মনে করেন, তাঁরা সব জানেন, সব বোঝেন। তাঁদের নতুন কিছু শেখার নেই। তার পরও আমরা বলি, বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরা গত পাঁচ-ছয় দশকে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এটা খুবই বিস্ময়কর যে পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে বাংলাদেশে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের জন্য এত প্রশিক্ষণ ছিল না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে পুরোপুরি কোনো বিভাগ ছিল না। কিন্তু সে সময়ও বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরা স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। অতীতের ওই সব সংবাদপত্র ও এর সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা এখনো আমাদের কাছে স্মরণীয়। তাঁদের সাফল্যের প্রধান কারণ তাঁরা ছিলেন নীতিনিষ্ঠ, সৎ ও পরিশ্রমী, তাঁরা সমাজ ও রাষ্ট্রের কথা ভাবতেন। সে আমলে এখনকার মতো এত বহুমুখী সুযোগ-সুবিধা তাঁদের সামনে ছিল না। কিন্তু আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা দিয়ে তাঁরা সব বাধা অতিক্রম করেছেন।

ব্যক্তির স্বার্থই প্রধান

বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে অসংখ্য কাগজ প্রকাশিত হয়েছে। দুই বছর আগেও ঢাকা শহরে নিবন্ধিত দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ১৮৬। এখন আছে ৭২টি। কিন্তু আমরা হয়তো চেষ্টা করলে বড়জোর এক ডজন কাগজের নাম বলতে পারব। সারা দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও উপজেলা সদরেও দৈনিক কাগজ আছে, সাপ্তাহিক কাগজও আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব কাগজের মালিক কোনো রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী; এমনকি কখনো কখনো কোনো সন্ত্রাসী। এসব সংবাদপত্র বিশেষ কোনো ব্যক্তির ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত হয়।

সে জন্য বাংলাদেশে গত দুই দশকে সংবাদপত্রে অনেক ভালো ভালো কাজ হলেও আমরা বলতে পারব না যে সামগ্রিকভাবে আমরা সাংবাদিকতা বা সংবাদপত্র–জগতে বিরাট কিছু একটা করতে পেরেছি। যদিও আমরা দেখতে পাই, নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একটা বড় পরিবর্তন আসে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রতি এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি থাকাকালে তিনি মুদ্রণ ও প্রকাশনা আইন সংশোধন করে সে পরিবর্তনের সূচনা করে গেছেন। সরকার চাইলেও এখন আর কোনো পত্রিকার প্রকাশনা রুদ্ধ করে দিতে পারে না। সেই সুবাদে আমরা, সাংবাদিকেরা অপেক্ষাকৃত স্বাধীন পরিবেশে কাজ করতে পারছি।

দলীয় পত্রিকার পাঠকপ্রিয়তা কমছে

একই সময় এ–ও আমাদের অভিজ্ঞতা যে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে পাঠকেরা কোনো বিশেষ দল বা ব্যক্তির দ্বারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরিচালিত কোনো পত্রিকা আর পড়তে চায় না। একসময়ের জনপ্রিয় কাগজ ‘ইত্তেফাক’, ‘ইনকিলাব’ বা ‘জনকণ্ঠ’–এর সেই পাঠকসংখ্যা এখন আর নেই। দল বা ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত কাগজগুলো ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে, তাদের পাঠক কমছে।

পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তরের দশকে পাঠকেরা প্রধানত রাজনৈতিক খবর জানতে কাগজ পড়ত। তখন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় কাগজ বের হতো। এ ধরনের কাগজ এখন পাঠক পড়তে চায় না। বিএনপি একটি বিরাট দল। বিগত বিএনপি সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদকালে ঢাকা শহরে তাদের পত্রিকা ‘দিনকাল’-এর বিক্রির সংখ্যা ছিল ৪৫০, এখন বেড়ে হয়েছে গড়ে ৭৫০ কপি। জামায়াতে ইসলামী একটা সংগঠিত রাজনৈতিক দল। তাদের মুখপত্র দৈনিক ‘সংগ্রাম’ ঢাকায় বিক্রি হয় গড়ে মাত্র ১ হাজার ২৬৫ কপি। এ রকম আরও অনেক হিসাব দেওয়া যায়। আওয়ামী লীগের সমর্থক পত্রিকাগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ‘বাংলার বাণী’র সম্পাদক থাকা সত্ত্বেও কাগজটা টিকে থাকতে পারেনি। অথচ ‘বাংলার বাণী’ একসময় একটি বড় কাগজ ছিল। এসব তথ্য প্রমাণ করে, পাঠক যে দলেরই সমর্থক হোক না কেন, নিজের সমর্থিত দলের কাগজ বা মুখপত্র সে পড়তে চায় না।

মালিকদের নিয়ে প্রশ্ন

আমাদের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়েছে। বেক্সিমকো শুধু বাংলাদেশে অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও একটা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ। তারা বারবার ঋণখেলাপি হয়, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিসহ নানা রকম কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তারা সংবাদপত্র–জগতে প্রবেশ করে। তারা একটা ইংরেজি দৈনিক, একটা বাংলা দৈনিক, একটা বিনোদন ম্যাগাজিন, একটা সাহিত্য পত্রিকা এবং একটা বার্তা সংস্থা নিয়ে প্রবলভাবে সংবাদপত্র–জগতে আসে। বাংলাদেশে এত বড় উদ্যোগ নিয়ে এ পর্যন্ত কেউ সংবাদপত্র–জগতে আসেনি। তাদের সে উদ্যোগের পেছনের উদ্দেশ্য ছিল পত্রিকাকে ব্যবহার করে ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা। সে সময় এই গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার সালমান এফ রহমান ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ নামে একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেছিলেন। দলটির চেষ্টা ছিল নির্বাচনে ২৫-৩০টি আসন নিয়ে ক্ষমতার অংশীদার হওয়া। কিন্তু তাদের পত্রিকাগুলো সফল হয়নি। শুধু ইংরেজি দৈনিক ও বিনোদন ম্যাগাজিনটি এখনো বের হচ্ছে।

বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রায় আট-দশটি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। কোনো আইনকানুন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে লাইসেন্সগুলো দেওয়া হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার ভাই, ছেলের বন্ধু, তাঁর দলের মন্ত্রী, সাংসদ বা তাঁর অনুগত ব্যবসায়ীদের। এর মধ্যে কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের অর্থায়নে জড়িত ছিল বিএনপি আমলের সবচেয়ে সুবিধাভোগী বসুন্ধরা, ওরিয়ন গ্রুপ প্রমুখ। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘যায় যায় দিন’ দৈনিক পত্রিকাটির প্রায় পুরো অর্থ সরবরাহ করেছিল বসুন্ধরা গ্রুপ। বিএনপি সরকারের সব রকম সহযোগিতা সত্ত্বেও শফিক রেহমানকে ‘যায় যায় দিন’ বিক্রি করে দিতে হয়েছে। দলীয় মন্ত্রী ও সাংসদের আট-দশটি টেলিভিশন চ্যানেল এবং কয়েকটি পত্রিকা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে বিএনপি কিছু করতে পারেনি।

এখন শুনতে পাচ্ছি, বর্তমান সরকারও নিজেদের দলীয় বা ব্যবসায়ী সমর্থকদের আট-দশটি টেলিভিশন চ্যানেল করার অনুমতি দেবে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের আমরা বিএনপি সরকারের দলীয় ব্যক্তিদের টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে বলব। যারা নানা কৌশলে টিভি চ্যানেল পাবে, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে বেক্সিমকো ও বসুন্ধরা গ্রুপের নাম বেশি শোনা যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে বেক্সিমকো গ্রুপের কিছু অপতত্পরতার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় বিএনপির সবচেয়ে বড় আর্থিক সহায়তাকারী ও বর্তমানে আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং অন্যরা নাকি টিভি চ্যানেলের জন্য লোকজন নিয়োগ করে ফেলেছেন। ইতিমধ্যে ‘ভোরের ডাক’ নামে একটি পত্রিকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তা পরিচালনা করছেন তাঁরা। আবেদ খানকে সম্পাদক করে ‘কালের কণ্ঠ’ নামে নতুন আরেকটি কাগজ বের করার প্রস্তুতি নিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। তারা আরও কাগজ বের করবে। সর্বশেষ খবর হলো, বসুন্ধরা গ্রুপ একটি টিভি চ্যানেল পেয়ে গেছে। ডিসকভারিসহ কয়েকটি বিদেশি চ্যানেল অধিক অর্থ দিয়ে দেশে প্রচারের ব্যবসা তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, প্রয়োজনে তারা শত শত কোটি টাকা খরচ করবে। তাদের দুর্নাম ঢেকে রাখতে প্রচারমাধ্যমের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এমনও শোনা যাচ্ছে, তাদের ওপর বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদ রয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েও সরাসরি দেখাশোনা ও দেন-দরবার হচ্ছে। তা না হলে দুর্নীতির কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত ও খুনের মামলার আসামি হয়েও এত কিছু করার মতো সাহসের উত্স কোথায়, সে ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে। বিগত বাজেটে সংবাদপত্রের নিউজপ্রিন্টের ওপর সরকার ট্যাক্স বাড়িয়েছে (ভ্যাটসহ যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশ)। অন্যদিকে বসুন্ধরা গ্রুপের কাগজের মিলের জন্য কাঁচামাল আমদানি ট্যাক্স শূন্য ছিল। এবার দেশীয় শিল্প রক্ষার অজুহাতে তাদের জন্য ভ্যাটও মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কেউ ‘প্রথম আলো’ সম্পর্কেও প্রশ্ন করতে পারেন। এর বিচারের ভার পাঠকদের ওপর থাকল।

এখানে তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ আছেন। তাঁকে আমাদের অনুরোধ, দেশের স্বাধীন সাংবাদিকতা পেশাকে সমুন্নত রাখতে চাইলে আপনারা নিয়মনীতি-শৃঙ্খলা রক্ষা করে টিভি দেবেন, রেডিও দেবেন ও পত্রিকা পরিচালনা করতে দেবেন।

সরকারি সুযোগ নিতে আগ্রহ

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করি, সরকারে দল পরিবর্তন হলে একদল সাংবাদিক কিছু পদ বা সুবিধা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যান। মন্ত্রীরাও দ্রুত পদগুলো দিয়ে দেন। প্রেস কাউন্সিলর হয়ে সাংবাদিকেরা যান ওয়াশিংটন, লন্ডন বা দিল্লিতে। এভাবে দলীয় সমর্থকদের কিছু পুরস্কার দেওয়ার রীতি তৈরি হয়েছে দেশে। তাঁদের যোগ্যতা আছে কি নেই, সেটা বিবেচ্য নয়—তাঁরা আমাদের সঙ্গে ছিলেন—এটা প্রধান বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। এর বাইরেও নানা সুযোগ-সুবিধা আছে। সাংবাদিক নেতারা এসব নিয়ে দেন-দরবার করেন। এখন নাকি সাংবাদিক নেতারা আবার সরকারি জমির প্লটের জন্য তালিকা করছেন।

আমরা জানি, সাংবাদিক সমাজও বিভক্ত। বহুদিন ধরে প্রধান দুই রাজনৈতিক ধারায় তাঁরা ভাগ হয়ে আছেন। ভবিষ্যতেও সাংবাদিকেরা এভাবেই বিভক্ত হয়ে থাকবেন, এমনটাই ধরে নেওয়া যায়। অনেক সাংবাদিক নেতার রুটি-রুজি এর সঙ্গে যুক্ত। সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রে এর গভীর প্রভাব পড়েছে। এর ফল ভালো কিছু হয়নি।

সাংবাদিক–জগতের দুর্নীতিও একটি বহুল আলোচিত বিষয়। আমরাও জানি, এই দুর্নীতি এক অস্বাভাবিক জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। এই দুর্নীতি থেকে কতজন মুক্ত আর কতজন মুক্ত নন—তার হিসাব করা কঠিন। অনেক পত্রিকা আছে, যেখানে সাংবাদিকেরা নিয়মিত বেতন পান না। সাংবাদিক যদি বেতন না পান, তাহলে তিনি কীভাবে সাংবাদিকতা করবেন। আজকাল অনেক মফস্বল শহরে এবং ঢাকায়ও নাকি খবর ছেপে টাকা নেওয়া হয় বা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে ‘প্যাকেট জার্নালিজম’ নামে একটা কথা সারা দুনিয়ায় প্রচলিত। বাংলাদেশে এই প্যাকেট জার্নালিজমের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এ অবস্থায় আমরা কীভাবে চলব, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ‘প্রথম আলো’তে আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছি। কোনো অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সরকারের হাতিয়ার বিজ্ঞাপন!

আমাদের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬—২০০১) আমলে, সেটা ২০০১ সালের জুনের কথা, সরকার হঠাৎ একবার রেগে গিয়ে ‘প্রথম আলো’য় সরকারি বিজ্ঞাপনের বরাদ্দ শূন্য করে দিল। আমাদের একটা মোবাইল নিউজ সার্ভিস ছিল। তত্কালীন প্রতিমন্ত্রী সেটা বন্ধ করে দিলেন। আমাদের অডিট রিপোর্ট তিন মাস পরপর পাস করাতে হয়। একবার আমরা অডিট রিপোর্ট পেলাম দেড় বছর পর। কারণ, মন্ত্রী দেবেন না। এরপর বিএনপির আমল এল। কিন্তু কয়েক মাস পরই ‘প্রথম আলো’র ওপর খেপে গিয়ে তারেক জিয়া আমাদের ডেকে গালমন্দ করলেন। তার পরপরই তাঁরা আমাদের বিজ্ঞাপন নির্ধারণ করে দিলেন দৈনিক ১০ ইঞ্চি। আমরা গিয়ে তথ্যমন্ত্রীকে বললাম, আপনারা খুব ভালো কাজ করেছেন। তবে আমাদের কোনো তদবির নেই। তবে যে সরকার এগুলো করে, তারা টিকে থাকতে পারে না। আমরা দেখলাম, তারা ক্ষমতায় থাকতে পারল না, হয়তো অনেক কিছুর জন্যই পারল না। তাদের বিদায় নিতে হলো। এর আগেও নব্বইয়ের দশকে বিএনপির সরকারের মন্ত্রী নাজমুল হুদা রেগে ‘ভোরের কাগজ’-এর জন্য বিজ্ঞাপনের বরাদ্দ শূন্য করে দিয়েছিলেন।

বেতন নেইতারপরও চলছে

সারা দেশে শত শত সাংবাদিক ছড়িয়ে আছেন। ‘প্রথম আলো’র প্রতিনিধির সংখ্যাও ঢাকার বাইরে ২২০। তাঁদের সবাইকে আমরা কমবেশি বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিই। ঢাকা শহর বা জেলা শহরে একজন সাংবাদিককে কাজ করতে গেলে নিয়মিত বেতন পেতে হবে। তাঁকে সামাজিকভাবে ভালো থাকতে হবে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে ঢাকা বা বাইরে কোনো কোনো সংবাদপত্রে কর্মীদের ৮ মাস, ১০ মাস বা ১৮ মাস ধরে বেতন দেওয়া হয় না। অনেক পত্রিকা থেকে সাংবাদিকেরা চলে গেলে বা চাকরিচ্যুত করা হলে তাঁদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হয় না। এ রকম পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের কীভাবে সততা, নিষ্ঠা, নীতি-নৈতিকতা ও ভালো সাংবাদিকতা করতে বলবেন? তিনি বাড়ি ভাড়া পাবেন না, থাকার জায়গা পাবেন না, সন্তানদের স্কুলে দিতে পারবেন না; তিনি কী সাংবাদিকতা করবেন!

দেশের বিভিন্ন স্থানে, অনেক শহরে একাধিক প্রেসক্লাব রয়েছে। এখনো রাজশাহীতে তিনটি প্রেসক্লাব। ঢাকা শহরে আছে রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাব-এডিটরস কাউন্সিল, অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিক সমিতি, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, কূটনৈতিক সংবাদদাতা সমিতি, সংসদবিষয়ক সাংবাদিক সমিতি, পরিবেশ সাংবাদিক সমিতি ইত্যাদি। সাংবাদিকদের কেন এত সংগঠন? এত সবের কী দরকার আছে? অনেকে হয়তো বিরক্ত হবেন, তবে এসবের পেছনে খুব ভালো কিছু দেখতে পাই না।

প্রশিক্ষণ জরুরিসঙ্গে আরও কিছু

আমরা শুরুতে প্রশ্ন তুলেছি যে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের দরকার আছে কি না। তারপরও আমরা বলতে চাই, সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণ খুব জরুরি। তবে সবচেয়ে জরুরি পেশার প্রতি ভালোবাসা, সততা আর নিষ্ঠা। একটা কথা আমরা আমাদের সাংবাদিকদের বলি, যতটা সম্ভব নম্র ও বিনয়ী থাকার চেষ্টা করতে হবে। সাংবাদিক সম্পর্কে নানা অভিযোগ রয়েছে সমাজে। তাঁরা বাড়াবাড়ি করেন, অভিযুক্তের কথা শুনতে চান না, সবকিছু ভালো করে জেনে-বুঝে নেন না, একজনের কাছে কিছু একটা শুনলে দ্বিতীয় কারও কাছ থেকে সেটা যাচাই করতে চান না ইত্যাদি। পত্রিকায়ও অনেক ভুল থাকে। খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক সময় সাধারণ নিয়মনীতি মানা হয় না। আমরা জানি, পত্রিকায় একটা ভুল খবরের কারণে একজন ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠান বহুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেদিকটি বিবেচনায় রেখে সাংবাদিক বন্ধুদের আমরা অনুরোধ করব, আপনারা লক্ষ রাখবেন যেন এমন কিছুর সঙ্গে আমরা যুক্ত হয়ে না পড়ি।

আমরা কথা বলছিলাম প্রশিক্ষণ নিয়ে। একটা সাপ্তাহিক কাগজে আমি দীর্ঘ সময় কাজ করেছি। তারপর দৈনিক পত্রিকায়। কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করেছি। আমি ছিলাম পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র। আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সাংবাদিকতার ধারে-কাছেও ছিল না। কিন্তু আমি একটি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। ১৯৯৫ সালে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি সংগঠন এশিয়ান মিডিয়া ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন সেন্টার (এএমআইসি) ঢাকায় একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। বিষয় ছিল ‘হাউ টু ইনক্রিজ রেভেনিউ ফর স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম রেঞ্জ নিউজপেপার ফ্রম অ্যাডভারটাইজমেন্ট অ্যান্ড সার্কুলেশন’। অর্থাৎ ছোট ও মাঝারি পত্রিকাগুলো কীভাবে পত্রিকা বিক্রি ও বিজ্ঞাপন থেকে আয় বাড়াতে পারে। বড় কাগজ নয়, এর লক্ষ্য ছিল ছোট ও মধ্যম পর্যায়ের পত্রিকার বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগের কর্মীরা। ওই তিন দিন বিভিন্ন পত্রিকার বাণিজ্য বিভাগের কর্মীরা আমার সঙ্গে প্রশিক্ষণে ছিলেন। একেবারে ছাত্রের মতো ওই তিন দিন যেটুকু শিখেছি, ওটুকুই এখনো আমার মূলধন এবং সেটুকু নিয়ে এখনো চলছি। বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করে। এ ধরনের কিছু প্রস্তাব আমাদের কাছেও এসেছিল; সুইডেন, কানাডা ও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের জন্য ওরা অর্থ ব্যয় করতে চায়। আমরা বলছিলাম, সাংবাদিকদের কী চাই, কী করা উচিত, কী তাঁদের কাজ হবে, সেটা জানা-বোঝা খুব জরুরি। তবে আগে প্রশিক্ষণ দিতে হবে সম্পাদক ও প্রকাশকদের। তিনি কী চান, তিনি কী কাজ দেবেন, কীভাবে কাজ বুঝে নেবেন, তাঁর ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, কীভাবে তিনি কর্মীদের পরিচালনা করবেন—প্রশিক্ষণ দিতে হবে সেসব বিষয়ে। তা না হলে কিছুই হবে না।

ওপর থেকেই শুরুটা হোক

আমরা বলতে চাই, সম্পাদক ও প্রকাশকদের জন্য যাত্রী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তাতে আমরা আসতে প্রস্তুত রয়েছি। কারণ, আমাদের দেশের পত্রিকা ও সংবাদকর্মীরা যেভাবে পরিচালিত হন, তাতে সংবাদ ও সংবাদপত্রের সঠিক পূর্বপরিকল্পনা বা সুনির্দিষ্ট ব্যবসায়িক কোনো লক্ষ্য থাকে না। ফলে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখনো খুব একটা এগোচ্ছে না। আমরা আগেই বলেছি, কেবল স্বাধীন দলনিরপেক্ষ সংবাদপত্রই বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে পারবে। অন্য কোনো সংবাদপত্র হয়তো টিকে থাকবে, কিন্তু ব্যবসায়িকভাবে সফল হতে পারবে না। টিকে থাকার জন্য হয় তাদের সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিতে হবে, না হয় বড় ও ধনাঢ্য বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে সাহায্য নিতে হবে। সরকার যদি ‘প্রথম আলো’য় বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমাদের নিজেদের শক্তিতে চলতে হবে। পাঠককে আস্থায় নিতে হবে, তারা যেন আমাদের কাগজ কেনে, পাঠকের কাছ থেকে যেন আমরা বিজ্ঞাপন পাই।

আরেকটা সমস্যা হলো, কোনো সরকার ক্ষমতায় এলে হিসাব করতে থাকে, কে আমার পক্ষে আর কে আমার বিপক্ষে। কয়েক মাসের মধ্যেই তারা এমন একটা অবস্থান নিয়ে নেয়। সত্য কথা হলো, তারা সব সময় সঠিক বিষয়টা বুঝতে পারে না। কিন্তু এসব পক্ষ-বিপক্ষের তত্ত্ব বোঝানোর জন্য সরকারের চারপাশে লোক জড়ো হয়ে যায় এবং সেই ভিত্তিতেই সরকার চলতে থাকে। তারা বলতে থাকে, এরা আমাদের বিরুদ্ধে, এরা পক্ষে, এরা আমাদের চায় না, এরা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, এরা বিরোধী দলের সঙ্গে বেশি ওঠাবসা করে ইত্যাদি। ব্যস, হয়ে গেল কাজ!

তথ্যমন্ত্রীকে আমরা অনুরোধ করব, সবার প্রতি সমান ব্যবহার এবং ধৈর্য ও সহানুভূতি ছাড়া মুক্ত সাংবাদিকতা কখনো সম্ভব নয়। আর যাত্রীকে অনুরোধ করব, আপনারা সম্পাদক ও প্রকাশকদের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে কাজ শুরু করুন, নইলে কাজের কাজ কিছু হবে না।