ডাক দিয়ে যায় একুশে ফেব্রুয়ারি

আমাদের কৈশোর-যৌবনের সাহসী দিনগুলি-রাতগুলি আর বছরের পর বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপনের উজ্জ্বল প্রেরণা একদম মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

সেই একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে এত কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা আর শোক মিছিল, শহীদ মিনারে শপথ গ্রহণ এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আহ্বান—সবকিছু নিয়েই আমাদের ভেতরে একটি গভীর ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণার বহমান ধারা তৈরি হয়ে আছে।

১৯৫৩-৫৪ সালে আমাদের সেই স্কুলজীবনের শুরুতে নবাবপুর রোডে একুশের প্রভাতফেরি আর শোক মিছিল দেখার সুযোগ হয়েছিল। মনে পড়ে, ১৯৫৬ সালে আরমানিটোলা মাঠে রাতে চাচাদের সঙ্গে শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে গান শুনতে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম শুনেছিলাম আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠে অবিস্মরণীয় গান ‘ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি...’। তবে ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। উত্তপ্ত স্লোগানে স্লোগানে সেবার একুশে ফেব্রুয়ারির পরিবেশ ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। সে দিনটির কথা খুব মনে পড়ে।

১৯৬২ সালে আমরা ঢাকা কলেজের ছাত্র। কিন্তু সে বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সামরিক শাসনবিরোধী প্রতিটি মিছিল-আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলাম প্রবল উত্সাহে। সে বছরই প্রথম ঢাকা কলেজ হোস্টেল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারির সকালের প্রভাতফেরির মিছিলে যোগ দিই। সেই সকালে মিছিল করে আজিমপুর কবরস্থানের গেটের কাছাকাছি পৌঁছাতেই ছোট একটি সংকলন হাতে পাই। সংকলনটির নাম ছিল পলাশ ফোটার দিন। প্রকাশ করেছিল সৃজনী লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠী। সেই সংকলন হাতে পাওয়ার স্মৃতি এখনো উজ্জ্বল। সেখান থেকে শহীদ বরকত, জব্বার ও  শফিউরের কবরে ফুল দিয়ে মিছিল করে পৌঁছে যাই শহীদ মিনারে।

১৯৬২ থেকে ’৭০ সাল পর্যন্ত সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ এবং নেতৃত্বের অবস্থানে থাকার কারণে একুশের সংকলন প্রকাশনা, সকালে শোক মিছিলে অংশ নেওয়া, সকাল বা বিকেলে কার্জন হল বা বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা এবং সন্ধ্যায় শহীদ মিনার ও পল্টন ময়দানে একুশের গানের অনুষ্ঠানে যুক্ত থাকা হয়ে উঠেছিল আমাদের জন্য এক অবশ্যপালনীয় কর্তব্য ও বিশেষ দায়িত্ব। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা পরিশ্রম করে এই সাংগঠনিক কাজগুলো করতাম আমাদের প্রাণের কাজ, ভালোবাসার কাজ হিসেবে।

১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসের সকালে প্রভাতফেরিতে অংশ নিয়ে শহীদ মিনারের ছাত্র-জনসভায় অংশ নিয়েছিলাম অনেকটাই সংগঠিতভাবে। তত দিনে আমি প্রকাশ্যে ছাত্র ইউনিয়ন ও গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নানা কাজে অত্যন্ত সক্রিয়। সেদিন বিকেলে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথাও মনে পড়ে। সে অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করার আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ আলী আহসানের অফিসে। তিনি পাঠ করেছিলেন ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতাটি। সেগুনবাগিচা রোডের বাসা থেকে ড. কাজী মোতাহার হোসেনকে রিকশায় করে কার্জন হলে নিয়ে এসেছিলাম আলোচনা সভায় অংশ নিতে। সে অনুষ্ঠানের নানা প্রস্তুতি থাকলেও কবিতা পাঠের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। শেষ পর্যন্ত কাউকে না পেয়ে উদ্যোক্তাদের চাপে পড়ে কী যে ভয়ের মধ্যে সৃজনীর একুশের সংকলন থেমে নেই থেকে বন্ধু আবুল হাসনাত আর আমি কবিতা পড়েছিলাম! কার্জন হলের একুশের ওই অনুষ্ঠানে কাজী আনোয়ার হোসেন গেয়েছিলেন সেই বিখ্যাত গান ‘ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি ও বাঙালি...’।

তারপর ১৯৬৪ থেকে ’৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ যে সংকলনগুলো প্রকাশ করেছিল, প্রতিটির সঙ্গে আমি কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলাম। একুশের সংকলন প্রকাশে বেশ আগ্রহ ও উত্সাহ ছিল আমার। কবি, লেখক ও শিল্পীদের কাছ থেকে সংকলনের জন্য লেখা ও ছবি এবং প্রচ্ছদ ও অলংকরণ সংগ্রহ প্রভৃতি কাজ বিশেষ উত্সাহ নিয়ে করতাম। এই সুযোগে তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হতাম এবং যোগাযোগ রাখতাম। বহু কিছু শিখেছি তাঁদের কাছ থেকে। তবে এই সংকলনগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে আবুল হাসনাত ও পরে মফিদুল হক যুক্ত ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে। মুনীরুজ্জামান, হিলালউদ্দিনসহ আরও অনেকে ছিলেন নিশ্চয়ই। যাঁরা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের সবার নাম মনে করতে না পারলেও তাঁদের কথা স্মরণ করি। সংকলনগুলোকে সব সময় উত্কৃষ্ট করার চেষ্টা ছিল আমাদের। সে সময় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের  সংকলনগুলোর মধ্যে আমাদের পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংগঠনের সংকলনগুলোই ছিল সেরা। কেন্দ্রীয় সংকলনের বাইরেও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা নগর ছাত্র ইউনিয়ন কমিটি, জগন্নাথ কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন কমিটি, ইডেন কলেজ বা রোকেয়া হল ছাত্র ইউনিয়ন ও আরও অনেকেই সংকলন প্রকাশ করত। সেগুলোর প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট অনেক কাজেও আমরা সহযোগিতা করতাম। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায়ও ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সংকলন বের করা হতো। তবে চট্টগ্রাম ছাত্র ইউনিয়নের সংকলনগুলো খুব ভালো মানের হতো, মনে পড়ে।

তারপরও বলব, অনেক উত্সাহ নিয়ে সংকলনের কাজগুলো করলেও নানা ভুলত্রুটি রয়েছে। একটি সংকলন পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশে যেসব অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন, সেসব আমাদের ছিল না তখন।

ষাটের দশকের ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সংকলনের নামগুলো ছিল খুব আকর্ষণীয়—‘প্রতিধ্বনি’ (১৯৬৪), ‘বিক্ষোভ’ (১৯৬৫), ‘ঝড়ের খেয়া’ (১৯৬৬), ‘সূর্য জ্বালা’ (১৯৬৭), ‘অরণি’ (১৯৬৮), ‘নিনাদ’ (১৯৬৯)। ‘প্রতিধ্বনি’ ছাড়া প্রায় প্রতিটি নাম আমরা রণেশদার (সাংবাদিক ও মার্ক্সবাদী পণ্ডিত রণেশ দাশগুপ্ত) কাছ থেকে নিয়েছিলাম। এ সংকলনগুলোর প্রচ্ছদের জন্য তখন আমরা দেশের সেরা শিল্পীদের কাছে যেতাম। ‘প্রতিধ্বনি’র প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী। ‘ঝড়ের খেয়া’, ‘অরণি’ ও ‘নিনাদ’—এই তিনটি সংকলনের প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী আবদুল মুকতাদির। ‘সূর্য জ্বালা’র প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী। সংস্কৃতি সংসদের প্রথম সংকলনের প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী হাশেম খান। পরের দুই বছর শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। এর বাইরে সংকলনগুলোতে যেসব চিত্র ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছিল, তার অনেকগুলো আমরা পুরোনো নানা সংকলন, বিশেষ করে ১৯৫৩ সালে কবি ও সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলন থেকে নিয়েছিলাম।

দেশের সেরা লেখকদের মধ্য থেকে সব সময় আমরা কয়েকজনের লেখা নিয়মিত নেওয়ার চেষ্টা করতাম। তাঁরাও প্রায় নিয়মিতই লেখা দিতেন আমাদের। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, সাংবাদিক ও লেখক শহীদুল্লা কায়সার, শিক্ষাবিদ ও লেখক আনিসুজ্জামান, বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী লেখক আবদুল হালিম, সাংবাদিক ও লেখক সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখ। আবার কবিদের মধ্যে জসীমউদ্দীন, বেগম সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হকসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকের লেখা প্রকাশ করেছি। ’৬৯-’৭০ সাল পর্যন্ত সংকলনগুলোতে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও কবিদের লেখার বাইরে নবীন কবি ও লেখকদের লেখা ছাপতাম। প্রধানত তত্কালীন ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের নেতা-কর্মীদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা ছাপা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই পরে বিশিষ্ট কবি-লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আজ তাঁদের অনেকেই বেঁচে নেই। কেউ কেউ আছেন বিদেশে।

ছাত্র ইউনিয়নের সংকলনগুলোর শুরুর একটি বা দুটি বিশেষ রাজনৈতিক লেখা ছাপা হতো গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের; নাম থাকত ছাত্রনেতা বা ভিন্ন কারও।

 

প্রতিধ্বনি, ১৯৬৪

১৯৬৪ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির সংকলন প্রকাশের কাজে প্রথম যুক্ত হই। সেবারই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন সংকলন বের করে। নাম ছিল ‘প্রতিধ্বনি’। মনে পড়ে যে তত্কালীন ছাত্র ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক জামাল আনোয়ারের (বাসু) সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম প্রেসে। নিউজপ্রিন্ট কিনে পৌঁছে দিয়েছিলাম। কয়েকটি লেখা সংগ্রহসহ অন্যান্য কিছু কাজও করেছিলাম।

‘প্রতিধ্বনি’ সংকলনে নিবন্ধ লিখেছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ফয়েজ আহমেদ, সাংবাদিক ও ‘ইত্তেফাক’-এর সহকারী সম্পাদক আহমেদুর রহমান, বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিক আনোয়ার জাহিদ প্রমুখ। এর বাইরে ছোট দুটি লেখা ছিল আবু নাহিদ ও শামসি জাহানের। আবু নাহিদ তখন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। শামসি জাহান কে, এখন আর মনে নেই।

আটজনের কবিতা ছিল ওই সংকলনে। তাঁরা হলেন সম্প্রতি প্রয়াত সৈয়দ আবদুস সামাদ (তত্কালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও পরে বাংলাদেশ সরকারের মুখ্য সচিব), মাসুদ আহমেদ (তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র ও পরে ডাক্তার), ‘সংবাদ’-এর সাংবাদিক মঞ্জুর আহমেদ (বর্তমানে নিউইয়র্কে থাকেন), প্রয়াত সাংবাদিক ও কবি শুভ রহমান ও শহীদুর রহমান (‘সংবাদ’-এর সাংবাদিক ও গল্পলেখক, প্রয়াত), সম্প্রতি প্রয়াত মাহমুদ আল জামান (আবুল হাসনাত), মতিউর রহমান (তখন আমার কবিতা লেখার চেষ্টার শুরু) ও দিলারা আহমেদ (বর্তমানে প্রখ্যাত অভিনেত্রী দিলারা জামান)।

‘প্রতিধ্বনি’ সংকলনে তিনটি গান ছাপা হয়েছিল—কবি জসীমউদ্দীন, সুরকার ও গায়ক আবদুল লতিফ এবং আবদুল করিমের।

‘প্রতিধ্বনি’র জন্য শুধু কালো রঙে প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী। পুরো সংকলনটি ছাপা হয়েছিল নিউজপ্রিন্টে। প্রচ্ছদ ছাপা হয়েছিল হোয়াইট প্রিন্ট কাগজে। প্রতিধ্বনির সম্পাদক ছিলেন সাইফউদ্দিন আহম্মেদ (মানিক)। তখন তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। প্রকাশক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক জামাল আনোয়ার (বাসু)। মূল্য ছিল ২৫ পয়সা। প্রকাশনার ঠিকানা ছিল ছাত্র ইউনিয়নের অফিস ৩১ হোসেনি দালান রোড, ঢাকা ২। সংকলনটি ছাপা হয়েছিল মীর্জা প্রিন্টিং ওয়ার্ক, ১৫ জিন্দাবাহার লেন, ঢাকা ১ থেকে।

 

বিক্ষোভ, ১৯৬৫

আমাদের মনে আছে, ১৯৬২-৬৩ সাল জুড়েই দেশব্যাপী শক্তিশালী শিক্ষা আন্দোলন হয়েছিল। রক্তক্ষয়ী হরতাল পালিত হয়েছিল ’৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। তার পর থেকে এ দিবসটি শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ’৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে এই দিনটিকে স্মরণ করে একটি সংকলন প্রকাশ, অর্থাৎ সংকলনের লেখা সংগ্রহ ও প্রকাশনার সব ব্যবস্থা নেওয়ার। সংকলনের নাম ঠিক করা হয়েছিল ‘সূর্য জ্বালা’। এই সংকলনের লেখকদের মধ্যে ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, শান্তি আন্দোলনের নেতা আলী আক্‌সাদ, সাংবাদিক বজলুর রহমান, আবদুল হালিম প্রমুখ। লেখা সংগ্রহ করতে গিয়েই এই বিশেষ লেখকদের কারও কারও সঙ্গে সেবার প্রথম যোগাযোগ ও পরিচয় হয়। আলী আক্‌সাদের কাছে লেখা চাইতে যাই ইত্তেফাক অফিসে। সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে তাঁর তাঁতীবাজারের বাসায় এক সকালে সেই আমার প্রথম পরিচয় হয়। সময়মতো তাঁদের সবার লেখা সংগ্রহ হয়ে যায়।

‘সূর্য জ্বালা’ নামের এই সংকলনটি আমরা ছাপতে দিয়েছিলাম ৬ নারিন্দা লেনের একটা প্রেসে। এটার মালিক ছিলেন কাজী মোজাম্মেল ইসলাম। তখন তিনি পৃথিবী নামের একটি মাসিক পত্রিকা বের করতেন। মোজাম্মেল ইসলাম ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ ও আমাদের নেতা মোহাম্মদ ফরহাদের বন্ধু। আমি সংকলনের লেখা সংগ্রহ করতাম এবং সেগুলো দিয়ে আসতাম প্রেসে। সেখানেই প্রুফ দেখা হতো। তখন প্রস্তুতি অনেকটাই এগিয়ে গেছে।

সেপ্টেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে একদিন দুপুরে প্রেসে গিয়ে শুনি, আগের রাতে পুলিশ এসে সব লেখা, সংকলনের কম্পোজ ম্যাটার নিয়ে চলে গেছে। এ খবর শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই। সেখান থেকে সোজা কার্জন হলের কাছে পুকুরের পাশের ভবনে আমাদের পরিসংখ্যান বিভাগের ক্লাসে গিয়ে আমি চুপচাপ বসে ছিলাম।

১৯৬৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা দিবসের সে সংকলন আর বের হয়নি। এই সংকলনের নামটি দিয়েছিলেন আমাদের রণেশদা। তবে ওই শিক্ষা দিবসের সংকলনের লেখাগুলো নিয়েই মূলত পরের বছরের ১৯৬৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি একটি সংকলন প্রকাশিত হয়, নাম ছিল ‘বিক্ষোভ’। এই ‘বিক্ষোভ’ নামটিও রণেশদার দেওয়া। প্রচ্ছদ করেছিলেন আমাদের শিল্পীবন্ধু প্রয়াত হাসান আহমেদ।

সেই সময় থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের সংকলনগুলো পরম যত্নে সংগ্রহ ও রক্ষা করে চলেছি। তারপরও ‘বিক্ষোভ’ সংকলনটি হারিয়ে ফেলেছি আমি। পরে আর কোথাও খুঁজে পাইনি। সেটি পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি এখনো।

‘বিক্ষোভ’-এর প্রথম লেখাটি ছিল রণেশ দাশগুপ্তের। শিরোনাম এখনো মনে আছে—‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শেষ হয়নি’।

 

ঝড়ের খেয়া, ১৯৬৬

১৯৬৬ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সংকলন প্রকাশের দায়িত্ব এসে পড়ে আমার ওপর। স্বাভাবিকভাবে বন্ধু আবুল হাসনাত ছিল আমার সঙ্গে।

‘ঝড়ের খেয়া’ নামের ওই সংকলনের শুরুতে তুলট কাগজে ছেপেছিলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ‘লাল গোলাপের জন্য’র অংশবিশেষ এবং একই সঙ্গে ছাপা হয়েছিল শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের আঁকা একটি লাল গোলাপের ভেতরে শান্তির কপোত। এই কবিতা ও আঁকা কপোতের ছবি পেয়েছিলাম কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘কালান্তর’ পত্রিকা থেকে। এটা ছাপতে পেরে আমরা উত্তেজিত ছিলাম।

সংকলনটির প্রবন্ধ লেখক তালিকায় ছিলেন সাইফউদ্দিন আহমেদ, আনিসুজ্জামান, রণেশ দাশগুপ্ত, আবদুল হালিম, আলী আক্‌সাদ এবং লেখক ও গবেষক মালেকা বেগম।

নয়জনের কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল—ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (অনুবাদ রণেশ দাশগুপ্ত), মাহমুদ আল জামান (এই পরিচয়ে কবিতা লিখতেন বন্ধু আবুল হাসনাত), সুব্রত বড়ুয়া (পরে বাংলা একাডেমিতে কাজ করেছেন এবং লেখক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত), মনোয়ার হুসাইন (প্রয়াত, তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র ও পরে চিকিত্সক), জি জি নেওয়াজ (যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী চিকিত্সক), ইউসুফ পাশা (প্রয়াত সাংবাদিক ও কবি), কাজী শওকত আনোয়ার (দৈনিক বাংলায় কর্মরত ছিলেন দীর্ঘ সময় এবং তখনকার ছাত্র ইউনিয়নের নেতা), হুমায়ুন কবির (তখনকার ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং চরমপন্থীদের হাতে নিহত) এবং মো. বদরুল হকের (পরিচয় মনে করতে পারছি না)।

‘ঝড়ের খেয়া’ সংকলনে দুটি গল্প ছাপা হয়েছিল। লেখক রেজাউর রহমান (পরে বিজ্ঞানী এবং গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত) এবং মহিউদ্দিন (প্রয়াত শিল্পী)।

সংকলনটি বাঁধাই করা হয়েছিল অভিনবভাবে। প্রচ্ছদসহ পুরো সংকলনটি চারটি ফুটো করে মোটা কালো সুতা দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছিল। মনে পড়ে, প্রচ্ছদ ও তুলট কাগজের এক পৃষ্ঠা ছাপা হয়েছিল প্রগতিশীল শিল্পী মোহাম্মদ ইদ্রিসের প্রেস থেকে। প্রেসটি ছিল হৃষিকেশ দাশ রোডে। তবে মূল সংকলনটি ছাপা হয়েছিল সোনার বাংলা প্রেস, ১০ যোগীনগর, ঢাকা ৩ থেকে। এই প্রেসটির খোঁজ দিয়েছিল আবুল হাসনাত। তার বাসস্থানের খুব কাছে ছিল।

‘ঝড়ের খেয়া’র জন্য প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন শিল্পী আবদুল মুকতাদির। সম্পাদনায় উল্লেখ ছিল, কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। প্রকাশক হিসেবে নাম ছিল নির্মলেন্দু চক্রবর্তী, প্রচার সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ৩১/১ হোসেনি দালান রোড, ঢাকা ২।

ঝড়ের খেয়ার পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫০, মূল্য ছিল ২৫ পয়সা। মনে পড়ে, ছাপা ও বাঁধাই শেষ করে সকাল হওয়ার আগে সংকলনগুলো প্যাকেট করে ফিরেছিলাম মেডিকেল হোস্টেলের সি-৫ নম্বর কক্ষে। সেটা ছিল সে সময়কার ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ডা. তাজুল ইসলামের কক্ষ। পরে সকালে নিয়ে যাই শহীদ মিনার ও বাংলা একাডেমিতে।

 

সূর্য জ্বালা, ১৯৬৭

সেই ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা দিবসের সংকলনের নাম ছিল ‘সূর্য জ্বালা’। সে নামটিই আমরা আবার গ্রহণ করলাম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ১৯৬৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির সংকলনে। ‘সূর্য জ্বালা’র জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। প্রথম লেখাটি, ‘শিক্ষানীতির প্রতিক্রিয়াশীল রূপ’ ছাপা হয়েছিল আবদুল্লাহ মোহাম্মদের নামে। আসলে লেখক ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। দ্বিতীয় লেখা, ‘পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা’—লেখক হিসেবে ছাপা হয়েছিল কাজী জামাল হোসেনের নাম। আসলে লেখাটি লিখেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা খোকা রায়। অন্যান্য প্রবন্ধের লেখক ছিলেন আনিসুজ্জামান, আবদুল হালিম।

একটি বিশেষ ফিচার ছাপা হয়েছিল—‘সূর্যমুখী দেশ ভিয়েতনাম’। লিখেছিলেন আমাদের প্রয়াত কবি ও সাংবাদিক বন্ধু শুভ রহমান। শুভ রহমান তখন দৈনিক ‘সংবাদ’-এ কাজ করতেন। মনে পড়ে, ‘সংবাদ’-এর রাতের পালার কাজ শেষ করে বংশালে আমাদের বাসার দোতলায় সারা রাত জেগে কাজ করেছিলেন। ফজরের নামাজের সময় আমার বাবা ঘরে বাতি জ্বলতে দেখে নিঃশব্দে ওপরে উঠে আসেন। দেখেন, শুভ রহমান লিখছেন। আমি পাশে বসে আছি। বাবা আমার রাজনীতি পছন্দ করতেন না। কিন্তু সেদিন রাতে আর কিছু বলেননি। শুভ রহমানের লেখাটি ছিল ছোট। তবে লেখার সঙ্গে আর্ট পেপারে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বেশ কয়েকটি ছবিও ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে ‘সূর্য জ্বালা’র যে কপিটি আছে, সেটাতে ছবির ওই কয়েকটি পৃষ্ঠা নেই।

‘সূর্য জ্বালা’ সংকলনে কবিতা ছাপা হয়েছিল আটটি। প্রথম কবিতাটি আমাদের পশতু বন্ধু আলী হায়দার খানের—‘তোমার প্রাণের ইচ্ছেগুলির জন্য’। তখন তিনি ঢাকায় থাকতেন। কবিতাটি অনুবাদ করেছিল মাহমুদ আল জামান (আবুল হাসনাত)। অন্য আরও যাঁদের কবিতা ছাপা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাজী শওকত আনোয়ার, ছড়াকার আখতার হুসেন, তখনকার চট্টগ্রাম ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক চট্টগ্রামের আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। আরও ছিলেন আমাদের বন্ধু ও দৈনিক ‘সংবাদ’-এর সদ্য প্রয়াত ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান, সে সময়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও প্রকৌশলী হিলালউদ্দিন, ছাত্র ইউনিয়নের জগন্নাথ হলের নেতা মিলন দত্ত এবং একজনের পরিচয় এখন মনে করতে পারছি না, তিনি আবু আহমদ চৌধুরী।

‘সূর্য জ্বালা’ সংকলনে গল্প ছাপা হয়েছিল দুটি—মাহমুদ আল জামান ও আশিষ আহমদের। আশিষ আহমদ কে, সে পরিচয় আর এখন মনে নেই।

‘সূর্য জ্বালা’র পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৮৮। সংকলনটির শুরুতেই একটা আলাদা পৃষ্ঠায় হলুদের ওপর লাল রঙের একটি ড্রয়িং ছিল শিল্পী কামরুল হাসানের। শিরোনাম ছিল ‘একুশের বিহঙ্গ’। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী।

‘সূর্য জ্বালা’র প্রিন্টার্স লাইনের পৃষ্ঠা নেই। খুঁজে পেলাম না। হয়তো ছাপাই হয়নি, কে জানে। সে জন্য আরও কিছু তথ্য আর পাওয়া গেল না। আমাদের অনেক ভালোর মধ্যে তেমন অপ্রস্তুতিও ছিল একই সঙ্গে।

 

অরণি, ১৯৬৮

১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে একুশের সংকলন বের করছিলাম—অরণি।

সংকলনে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো ছিল দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের। লিখেছিলেন অধ্যাপক মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, বদরুদ্দিন উমর, মাহমুদ আল জামান। শিল্প ও শিক্ষা আন্দোলন নিয়ে বিশেষ লেখা ছিল সৈয়দ মোয়াজ্জেম হাসান নামের একজনের। আসলে এই লেখার লেখক ছিলেন গোপন কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ  ফরহাদ।

‘অরণি’তে ছয়জন কবির কবিতা ছেপেছিলাম। প্রথম কবিতাটি ছিল পশতু কবি আজমল খাটকের। অনুবাদ করেছিল মাহমুদ আল জামান। এর কিছু সময় আগেই কবি আজমল খাটক ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের অনেক আনন্দঘন সময় কেটেছিল তখন। সে বছরই পাকিস্তানে গেলে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের মর্দান জেলার একটি এলাকা খোরাখাটাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। গল্প করেছিলাম বাড়ির সামনের আঙিনায় খাটিয়ার ওপর বসে। খাওয়াদাওয়াও সেখানেই হয়েছিল। পরে ১৯৮৮ সালে কাবুলে আবার দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। অনেক সময় কাটিয়েছিলাম। সেখানে তিনি পালিয়ে ছিলেন তখন। তিনি ন্যাপের (ওয়ালী খান) নেতা ছিলেন। পাকিস্তানের নির্বাচিত সিনেট সদস্য ছিলেন নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে। চার বছর আগে তিনি মারা গেছেন।

আরও কবিতা ছিল আখতার হুসেন, বেবী মওদুদ, মাসুদ আহমেদ মাসুদ, মুরশেদ-নূর-শাহিরয়ার এবং কাজী হাসান হাবিবের। বরিশালের মাসুদ আহমেদ মাসুদ ছিলেন এঁদের মধ্যে প্রতিভাবান কবি ও ভালো ছাত্র। অল্প বয়সেই মস্তিষ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালপ্রয়াণ ঘটে তাঁর। তাঁর কথা মনে পড়ে। কী এক টগবগে তরুণ ছিলেন! একইভাবে ঘনিষ্ঠ তরুণ বন্ধু শিল্পী কাজী হাসান হাবিব কবিতাও লিখত। তার পরিবারের সবার সঙ্গেই ছিল আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতা। বড় দুঃখ যে দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অল্প বয়সেই তারও মৃত্যু হলো। ছাত্র ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ ও পরে আওয়ামী লীগের সাংসদ বেবী মওদুদ কবিতা লিখতেন। তিনিও নেই। আখতার হুসেন মূলত ছড়াকার। কবিতাও লেখেন। মুরশেদ-নূর-শাহিরয়ার কে ছিলেন, মনে নেই।

‘অরণি’তে দুটি গল্প ছাপা হয়েছিল। জহির রায়হানের কাছ থেকে নতুন গল্প পাওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থতায় তা আর হয়ে ওঠেনি। জহির ভাই প্রস্তাব করলেন তাঁর ‘একুশের গল্প’টি (১৯৫৬ সালে ‘একুশের সংকলন’-এ প্রকাশিত) ছাপতে। সেটাই আমরা ছেপেছিলাম। আরও একটি গল্প লিখেছিলেন অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ। এই দুই লেখককে আমরা সব সময় বিশেষভাবে স্মরণ করি।

‘অরণি’র প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী আবদুল মুকতাদির। সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। প্রকাশক হিলালউদ্দিন। ছাপা হয়েছিল কনসুলেট প্রেস, ৩৮ বামাচরণ চক্রবর্তী রোড, ঠাঁটারীবাজার, ঢাকা থেকে। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৬৪। মূল্য পঞ্চাশ পয়সা।

 

নিনাদ, ১৯৬৯

১৯৬৯ সালের সেই গণ-আন্দোলন আর গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে নিনাদ নামের সংকলনটি বের করেছিলাম। সংকলনটি ঠিক আগের মতো অতটা পরিকল্পিত বলে এখন মনে হচ্ছে না। কারণ, তখন তো আমরা প্রতিদিন ব্যস্ত রাজপথের লড়াই-সংগ্রামে। তারপরও সেটাই সে বছরের প্রকাশিত সংকলনগুলোর মধ্যে সেরা সংকলন।

সংকলনটিতে প্রবন্ধ লিখেছিলেন আনিসুজ্জামান, মালেকা বেগম, রণেশ দাশগুপ্ত, সাংবাদিক সৈয়দ আবু জাফর (সে সময় বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন) ও আবদুল হালিম। কবিতা লিখেছেন আটজন—শামসুর রাহমান, শুভ রহমান, মতিউর রহমান, পশতু কবি আলী হায়দার খান, কাজী হাসান হাবিব, মাসুদ আহমেদ মাসুদ, আখতার হুসেন ও মনোয়ার (তিনিই চিকিত্সক মনোয়ার হুসাইন কি না, এখন ঠিক মনে করতে পারছি না)। ‘নিনাদ’-এ কোনো গল্প না থাকলেও সত্যেন সেন লিখেছিলেন বিপ্লবী কৃষকনেতা জিতেন ঘোষের প্রথম জেলে যাওয়া ও শাস্তির বিষয় নিয়ে একটি চমত্কার লেখা।

‘নিনাদ’-এর প্রচ্ছদও করেছিলেন শিল্পী আবদুল মুকতাদির। সম্পাদক ছিল ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আবুল হাসনাত। প্রকাশক ছিলেন হিলালউদ্দিন, সে সময়ের ছাত্র ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক। ছাপা হয়েছিল অন্তরীপ মুদ্রণালয়, ২৫৫ জগন্নাথ সাহা রোড, ঢাকা ১ থেকে। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৪৮। মূল্য ৫০ পয়সা।

 

 

দিনের রৌদ্রে আবৃত বেদনা, সংস্কৃতি সংসদ, ১৯৬৮

১৯৬৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের পক্ষ থেকে শুধু কবিতা নিয়ে একটি সংকলন বের করছিলাম—‘দিনের রৌদ্রে আবৃত বেদনা’। সেটাই ছিল আমাদের সময়ে সংস্কৃতি সংসদের প্রথম একুশের সংকলন। কেন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেটা এখন আর মনে নেই। হয়তো ভেবেছিলাম, আমরা ছাত্র ইউনিয়নের সংকলন করছি, সংস্কৃতি সংসদের একটা সংকলন হলে ভালো হয়। তখন আমি সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক। সে সময় বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে সংস্কৃতি সংসদ। তার পরের কমিটির সভাপতি আসাদুজ্জামান নূর এবং সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসনাত। আবার তার পরের কমিটির সভাপতি ছিল আবুল হাসনাত ও সাধারণ সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম। তখন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কেন্দ্র করে সংস্কৃতি সংসদ বড় একটি সংগঠন হয়ে ওঠে। অনেক বড় অনুষ্ঠানও তারা করেছে তখন।

সংস্কৃতি সংসদের সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু করি সংকলনের জন্য কবিতা সংগ্রহের কাজ। যাঁদের লেখা ছেপেছিলাম, তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবি জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ, শহীদ সাবের ও সন্তোষ গুপ্ত। সে দিনগুলোতে অসুস্থ শহীদ সাবের হঠাৎ হঠাৎ ‘সংবাদ’-এর নিউজপ্রিন্টের প্যাডে ছোট ছোট সুন্দর কবিতা লিখতেন। তেমনই একটি কবিতা ছিল সেটি। এ ছাড়া সতেরোজন কবির মধ্যে আরও ছিলেন শুভ রহমান, সোলায়মান, গোলাম মোহাম্মদ মাস্তানা, মোজাম্মেল হোসেন, মাহমুদ আল জামান, কাজী মমতা হেনা, মফিদুল হক, বেলা ইসলাম, মনোয়ার, মুনীরুজ্জামান ও বেবী মওদুদ। সোলায়মান ছিলেন সৃজনী লেখক গোষ্ঠীর সদস্য। গোলাম মোহাম্মদ মাস্তানা ও মোজাম্মেল ‘সংবাদ’-এ কাজ করতেন। অন্যরা সবাই তখন ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের তরুণ কর্মী এবং লেখালেখিতে বেশ উত্সাহী। তাঁদের মধ্যে বেলা ইসলাম সে সময়ের ভালো নজরুলসংগীতশিল্পী ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে চট্টগ্রামে শিক্ষকতা করছেন। আমাদের শিল্পী বন্ধু কাজী হাসান হাবিবের বড় বোন কাজী মমতা হেনা ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী। মুনীরুজ্জামান ছাত্র ইউনিয়নের জঙ্গী কর্মী ছিলেন। মাহমুদ আল জামান, মফিদুল হক ও বেবী মওদুদ তখন আমাদের সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী।

এসব প্রস্তুতি যখন চলছে, তখন প্রশ্ন দেখা দিল, কে প্রচ্ছদ করবেন, কার কাছে যাব। এগুলো নিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে যাই। কারণ, সে সময় ছাত্র ইউনিয়নের সংকলনের নিয়মিত প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন আবদুল মুকতাদির। আর, কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে তখনো পরিচয় হয়নি।

মনে আছে, আরও অনেকের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও সংস্কৃতি সংসদের এই সংকলনের প্রচ্ছদ ও অলংকরণের জন্য নানা চিন্তা নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় আমি যাই শিল্পী হাশেম খানের কাছে। তাঁর বড় ভাই ডা. সোলায়মান খান আমাদের রাজনৈতিক সঙ্গী ছিলেন। হাশেম খান তখন গোপীবাগে থাকতেন। তাঁর কাছে যেতেই আমাদের প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেন তিনি। সংকলনের নাম জিজ্ঞেস করলেন। তখনো কোনো নাম ঠিক করিনি আমরা। হাশেম খান প্রচ্ছদ ও পুরো সংকলনের অঙ্গসজ্জা করলেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে সংকলনটির নামকরণও করে দিলেন—‘দিনের রৌদ্রে আবৃত বেদনা’—রবীন্দ্রনাথের কবিতার পঙ্‌ক্তি দিয়ে। সংকলনের নামটি বেশ সমাদৃত হয়েছিল।

সংকলনটির জন্য কবি শামসুর রাহমানের কাছে কবিতা চাইতে যাই দৈনিক ‘বাংলা’ অফিসে। তাঁর সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। তখন তিনি দৈনিক ‘বাংলা’র সহকারী সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের পরিচয় দিয়ে কবিতা চাইলেই তিনি তাত্ক্ষণিক সম্মতি প্রকাশ করলেন। তাঁর আশেক লেনের বাসার ঠিকানা দিয়ে দিলেন। গিয়ে কবিতা নিয়ে আসতে হবে। নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখি কবিতা প্রস্তুত। ডায়েরিতে লেখা কবিতা কপি করে রেখেছিলেন। তিনি বললেন, ‘কবিতাটি পাঠ করি!’ তারপর তাঁর স্বাভাবিক গভীর কণ্ঠে পাঠ করলেন ‘আমার স্বরের ডালে’—আমার অন্যতম প্রিয় একটি কবিতা। কবির সঙ্গে সেই যে পরিচয়, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তা আমৃত্যু টিকে ছিল গভীরভাবে। এখনো আমি মাঝেমধ্যেই একা একা উচ্চ স্বরে পাঠ করি ‘আমার স্বরের ডালে’ কবিতার সেই পঙ্‌ক্তিগুলো। একাধিক প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে আমি পঙ্‌ক্তিগুলো পাঠ করেছি:

ভদ্র মহোদয়গণ,

এই গাছপালাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন,

ঘরের এক কোণে রাখা ভাঙা হারিকেন,

সেজো-অধ্যুষিত গলির কানা বেড়াল

অথবা মেথরপট্টির নেড়ী কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন

আমরা সুখী নই কেউ।

বিশ্বাস করুন,

এদেশের পোকামাকড় জীবজন্তুগুলোসুদ্ধ ভীষণ অসুখী।

এখনো যেন শামসুর রাহমানের সেই স্বর শুনতে পাই। বায়ান্ন বছর পরও কবিতার লাইনগুলো সময়ের সঙ্গে কী তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে হয়!

একুশে ফেব্রুয়ারি ‘দিনের রৌদ্রে আবৃত বেদনা’ ছাপা শেষ করে বাঁধাই হয়ে গেলে সকালেই নিয়ে হাজির হয়েছিলাম বাংলা একাডেমিতে। সংকলনটি ছাপা হয়েছিল অ্যাসোসিয়েট প্রেস, ৩/১, লিয়াকত অ্যাভিনিউ থেকে। প্রকাশক ছিলাম আমি—তখন সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক। সংকলনের সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল মাহ্ফুজ আনাম (বর্তমানে ‘ডেইলি স্টার’-এর স্বনামধন্য সম্পাদক; তখন তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত), প্রয়াত সাংবাদিক তারিক আহাসান (প্রয়াত সচিব এ কে এম আহসানের পুত্র), লেখক ও সাংবাদিক বেবী মওদুদ (প্রয়াত), বর্তমানে লেখক ও সংগঠক মফিদুল হক এবং শিক্ষক ও গায়িকা বেলা ইসলামের। এই সংকলনের জন্য কয়েকটি বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করেছিলাম। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩৪। মূল্য ৫০ পয়সা।

 

 

বজ্রে বাজে বাঁশী, সংস্কৃতি সংসদ, ১৯৬৯

১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তুমুল আন্দোলনের সময় এসে আমাদের মনে হলো যে সংস্কৃতি সংসদের পক্ষ থেকে আবারও নতুন কিছু একটা করতে হবে। তখন সংস্কৃতি সংসদ খুব শক্তিশালী সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় তো ধর্মঘট আর কারফিউ—সবকিছু চলছে। চারদিকে মহা উত্তেজনা।

এই ভাবনা থেকে আসাদুজ্জামান নূর (তখন সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি) ও আমি একদিন সকালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হল থেকে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর বাসায় যাই। তাঁকে বলি, কাইয়ুম ভাই, আপনাকে প্রচ্ছদ করে দিতে হবে। তিনি সম্মতি দেন। এরপর চার রঙের একটি প্রচ্ছদ করে দিলেন। কবিতার এই সংকলনটির নাম ছিল ‘বজ্রে বাজে বাঁশী’। মূলত আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক ও আমি কবিতা সংগ্রহ করেছিলাম। নিশ্চয়ই আরও কারও সাহায্য পেয়েছিলাম। তবে এখন আর পরিষ্কারভাবে মনে পড়ে না।

কবি জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, সিকান্দার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, শহীদুল্লা কায়সার, আল মাহমুদ, সন্তোষ গুপ্ত, মোহাম্মদ মুনীরুজ্জামান, সিলেটের দিলওয়ার, উর্দু কবি আহ্‌মদ নদীম কাস্‌মী (রণেশ দাশগুপ্ত অনূদিত), এনামুল হক, মাহমুদ আল জামান, মোজাম্মেল হোসেন, আখতার হুসেন, বেলা ইসলাম, বেবী মওদুদ ও শান্তিপ্রিয় চৌধুরীর কবিতা ছিল সংকলনটিতে। নতুনদের মধ্যে শান্তিপ্রিয় চৌধুরী সাংবাদিকতা করেছেন, কবিতা লিখেছেন। এনামুল হকের কবিতাও ছিল। তিনি কে ছিলেন, এখন আর মনে নেই।

মনে পড়ে, একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারির এক সপ্তাহ আগে সকালে শহীদুল্লা কায়সারের বাসায় গেলাম কবিতা আনতে। তিনি শোবার ঘরের বিছানার ওপর উপুড় হয়ে ডায়েরি থেকে কপি করে ‘নক্ষত্র যখন ফুল হবে’ কবিতাটি আমার হাতে দিলেন। উত্সর্গ করলেন কিশোর শহীদ মতিউরকে।

‘বজ্রে বাজে বাঁশী’র প্রকাশক ছিলেন মফিদুল হক। সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ ছিল সংস্কৃতি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা।

কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের নতুন একটি প্রস্তাব দিলেন, ‘এই সংকলনে শিল্পীদের দুটি ড্রয়িং দাও। আমি একটা দেব, মুর্তজা বশীরের কাছ থেকে আরেকটা নাও।’ কাইয়ুম ভাইয়ের প্রস্তাবে দুটি ড্রয়িং অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ড্রয়িং আনতে গিয়ে বহু বছর পর আবার যোগাযোগ হলো শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গে। তিনি নবাবপুর গভমেন্ট হাইস্কুলে আমাদের ড্রয়িং শিক্ষক ছিলেন। তখন থাকতেন চকবাজারের ৭৯ বেগমবাজারে, তাঁর বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র বাসায়। মুর্তজা বশীর ড্রয়িং দিয়েছিলেন এবং সেটা ছাপা হয়েছিল।

 

কাইয়ুম চৌধুরীর নতুন প্রস্তাব: শিল্পীদের কাজ নিয়ে সংকলন

১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আরেকটি নতুন প্রস্তাব দিলেন—একুশে ফেব্রুয়ারি অবলম্বনে শিল্পীদের আঁকা ড্রয়িং নিয়ে একটি সংকলন বের করার। তাঁর উত্সাহে আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে রাজি হয়ে গেলাম। শিল্পীদের একটি তালিকা দিলেন কাইয়ুম ভাই। তখন দুর্বার আন্দোলন চলছে। কারফিউর ফাঁকে ফাঁকে আমরা শিল্পীদের বাসায় বাসায় গেলাম। এই সংকলনটি আমরা করেছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে, ছাপা হয়েছিল অ্যাসোসিয়েট প্রেস থেকে।

শিল্পী কামরুল হাসান এঁকেছিলেন ‘নতুন দিনের ভোর’। রশীদ চৌধুরী এঁকেছিলেন ‘বাংলার বিদ্রোহী’। শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া ও দেবদাস চক্রবর্তীর আঁকা ছবিও সহজে পেয়ে গিয়েছিলাম। মুর্তজা বশীর এঁকেছিলেন ‘জননী ভূলুণ্ঠিত’; দেবদাস চক্রবর্তীর স্কেচ ছিল ‘ধর্ষিত দেশ’; নিতুন কুন্ডু এঁকেছিলেন ‘শান্তির জন্য’; ইমদাদ হোসেন ‘আহত ভাষা সৈনিকের স্লোগান’; প্রাণেশ কুমার মণ্ডল আঁকলেন ‘ওরা’—পাকিস্তানি সৈন্য ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। রফিকুন্নবীর আঁকা ছিল ‘বায়ান্ন থেকে ঊনসত্তর’।

একদিন সকালে কারফিউর ফাঁকে অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পী আমিনুল ইসলামের বাসায় গিয়ে ড্রয়িং নিয়ে এসেছিলাম আমরা। অতুল প্রসাদ সেনের লেখা ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ’মরি বাংলাভাষা’ গানটি অবলম্বনে একটি স্কেচ এঁকে দিয়েছিলেন তিনি। মনে পড়ে, শিল্পী হামিদুর রাহমান শহীদ মিনারের ম্যুরালের প্রস্তুতিকালের কাজের একটি অংশ দিয়েছিলেন ছাপাতে। অভ্যন্তরে অঙ্কিত দেয়ালচিত্রের একাংশ।

’৬৯-এর সেই ফেব্রুয়ারিতে বিপুল আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান—এমন একটি পরিবেশ ছিল। এই সংকলনটির প্রচ্ছদও কাইয়ুম চৌধুরী করেছিলেন সে বছরের ছাত্র ইউনিয়নের সংকলন ‘নিনাদ’-এ প্রকাশিত শামসুর রাহমানের ‘পুলিশ রিপোর্ট’ কবিতার পঙ্‌ক্তি থেকে। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলো উদ্ধৃত করছি:

লোক,

আমাদের চোখের পাতায়

                         লোক।

লোক,

পাঁজরের প্রতিটি সিঁড়িতে

                         লোক।

লোক,

ধুকপুকে বুকের স্কোয়ারে

                         লোক।

সংকলনটিতে সম্পাদক বা প্রকাশকের কোনো নাম উল্লেখ ছিল না। মূল্য ছিল ৫০ পয়সা। প্রচ্ছদ বলতে গেলে প্রায় বেগুনি রঙের—একরঙা। ভেতরে ১১ জন শিল্পীর ড্রয়িং। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ইচ্ছা অনুযায়ী যে সংকলনটি করতে পেরেছিলাম, সে জন্য এখনো অনেক বড় কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করে।

একটি বিরাট পরিবর্তনের সম্ভাবনায় যখন কাঁপছে সারা দেশ এবং একটি প্রচণ্ড ভয়েরও পরিস্থিতি দেশের সামনে—তখনো দেশের সেরা শিল্পীরা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, সাহস দিয়েছিলেন। তাঁদের কথা আমরা সব সময় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি।

 

কবিতা আর ছবি, সংস্কৃতি সংসদ, ১৯৭০

পরের বছর, ১৯৭০ সাল, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রস্তুতির বছর। সাধারণ নির্বাচনের বছর। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের নিয়মিত সংকলনের বাইরে এবার সংস্কৃতি সংসদকে একুশের স্মরণে প্রকাশের বিশেষ একটি প্রস্তাব দিলেন। এবার আরেকটু বড় পরিসরে—সেরা সব কবিদের কবিতার পাশে একজন সেরা শিল্পীর আঁকা ছবি। বিষয় হবে একুশে ফেব্রুয়ারি ও চলমান গণ-আন্দোলন। এ প্রস্তাবেও আমরা উত্সাহভরে সায় দিলাম এবং কাজটি করলামও। কবিতা আর ছবি সংগ্রহ থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ কাজটির সঙ্গেই পুরোপুরি যুক্ত ছিলাম, যদিও তখন আমি ছাত্র ইউনিয়ন বা সংস্কৃতি সংসদে সরাসরি যুক্ত নই বা কোনো দায়িত্বে নেই। কিন্তু উত্সাহের শেষ নেই। মনে পড়ে, আবুল হাসনাত, মফিদুল হকসহ অন্যদের সাহায্য পেয়েছিলাম অনেক। ছাপা শুরুর এক দিন আগেও দুপুরে আমার অনুরোধে কাইয়ুম ভাই প্রেসে এসে (অ্যাসোসিয়েট প্রেস) প্লেট তৈরি করা, ছাপা ও ব্যবস্থাপনা—সবকিছুর যাবতীয় পরামর্শ দিয়ে দেখে গিয়েছিলেন।

অতি উত্সাহের সঙ্গে কবিতা দিয়েছিলেন কবি জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, সিকান্দার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, সন্তোষ গুপ্ত, শহীদ সাবের, নিয়ামত হোসেন, মাহমুদ আল জামান, কাজী মমতা হেনা, মাসুদ আহমেদ মাসুদ, কাজী হাসান হাবিব ও আসেম আনসারী। মোট ১৫ জন কবির কবিতা ছেপেছিলাম। আসেম আনসারী শিল্পী, কাজী হাসান হাবিবের বন্ধু ছিলেন।

সেই ১৯৭০ সালে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রস্তাব অনুযায়ী একুশ ফেব্রুয়ারি বা সে সময়ের গণ-আন্দোলনের ঘটনাবলি নিয়ে আঁকা বিদ্রোহী চিত্রগুলো যাঁরা এঁকে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, রশীদ চৌধুরী, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, ইমদাদ হোসেন, মুস্তাফা মনোয়ার, প্রাণেশ কুমার মণ্ডল, রফিকুন্নবী, হাশেম খান, মহিউদ্দিন ফারুক প্রমুখ। সেই ঝঞ্ঝাময় আন্দোলনের দিনগুলোতে কবি আর শিল্পীদের বাড়িতে একাধিকবার গিয়ে আঁকা ছবি সংগ্রহ করে নিয়ে আসা খুব সহজ কাজ ছিল না। আমাদের দেশের কবি ও শিল্পীদের আন্তরিক সহযোগিতায় এটা সম্ভব হয়েছিল।

মনে পড়ে, ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে সারা দিন সারা রাত আমি প্রেসে ছিলাম। পুরো প্রেসের সব কর্মী এবং ৮-১০টা মেশিন সে রাতে শুধু আমাদের কাজ করেছিল। সব ছাপা ও বাঁধাই শেষ করে একুশের প্রভাতে এই সংকলনগুলো শহীদ মিনার ও বাংলা একাডেমিতে বিলি ও বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

ভাবতে অবাক লাগে, পুরো প্রেসে ছাত্র ইউনিয়ন আর সংস্কৃতি সংসদের নানা ধরনের সংকলনের ছাপার কাজ চলছে। এক প্রচণ্ড উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে। সময়ের সঙ্গে, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে মেশিন এবং ছাপাখানার বাঁধাইকাজ। সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।

এ সংকলনটিরও প্রচ্ছদ করেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। প্রকাশক ছিলেন মাহফুজ আনাম। সম্পাদক হিসেবে ছিল সংস্কৃতি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলী। মূল্য এক টাকা পঞ্চাশ পয়সা।

 

ষাটের দশক এবং ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদ

পুরো ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি সংস্কৃতি, সংগীত, নাচ, আবৃত্তি, নাটক ও অন্যান্য বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে বড় ভূমিকা পালন করেছে বামপন্থী শক্তি, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ। সে সময়ের সেরা নাটক, সেরা নৃত্য, সেরা গান বা গণসংগীতের বড় অনুষ্ঠান যেমন আমরা করেছি, একই সঙ্গে ১৯৬৪ সাল থেকে একুশ নিয়ে সেরা সংকলনগুলোও আমরাই করেছি। কোনো রকম সংকীর্ণতা ছাড়াই সব মত ও চিন্তার লেখক-শিল্পীদের আমরা যুক্ত করার চেষ্টা করেছি এবং সফল হয়েছি। আসলে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই এই প্রচেষ্টা চলছিল।

আমাদের লক্ষ্য ছিল বড় পরিসরে—নানা চিন্তাভাবনার সেরা সব মানুষকে একটি বড় জায়গায় দাঁড় করানো। বলা যায় আমরা চেষ্টা করেছিলাম শুধু রাজনীতি নয়, শিল্প, সংস্কৃতি বা গান প্রভৃতি বিষয়ে একটি বড় যৌথ মঞ্চ গড়ে দিতে, যেখানে সব খ্যাতিমান ও প্রতিশ্রুতিশীল মানুষজন এসে দাঁড়াবেন। যেকোনো ঘটনায় আমরা সেরাদের স্বাক্ষরযুক্ত বিবৃতি নিতাম। ছোট-বড় অনুষ্ঠান করতাম। আমাদের সেই সব কাজে কবি-লেখকেরা যেমন ছিলেন, ছিলেন মেধাবী শিক্ষক-ছাত্ররাও। অথবা যাঁরা প্রচ্ছদ বা অলংকরণ করেছেন সে সময়, সবাই কিন্তু সেরা শিল্পী—যেমন সেই আমলে, একইভাবে এই আমলেও। ষাটের দশকের সেই শিল্পীরা একই সঙ্গে ছিলেন জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল। শামসুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক বা আল মাহমুদকে যেমন আমরা পেয়েছি আমাদের সঙ্গে, জসীমউদ্দীন বা সুফিয়া কামালদেরও পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি। উদাহরণ হিসেবে বলি, শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সে সময় তিনি কোনো রকম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু যেভাবেই হোক, তখন তাঁর প্রায় সব লেখায় সে সময়ের উত্তাল রাজনীতির প্রতি দৃঢ় একটি সমর্থন পাওয়া যায়। এ ছাড়া নানা সভা-সমাবেশে যোগ দিয়েছেন তিনি। সেই একই সময়ে পরিচয় হয়েছিল কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।

সংস্কৃতি সংসদের এত বহুমুখী সাংস্কৃতিক কাজগুলোকে সফল করে তুলতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা যুক্ত ছিলেন। তাঁদের কথা আমরা জানি। অনেক ছাত্র-ছাত্রীও স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিনরাত কাজ করেছে। বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্তদের বাইরে যাঁদের নাম উল্লেখ করতে হয়, তাঁদের মধ্যে শিল্পী ইকবাল আহমেদ, সুলতানা কামাল, মাসুদা মতিন, শিরীন হক, কাজী ইকবাল, জুলফিকার রানা, আহরার আহমেদ প্রমুখ ছিলেন খুবই সক্রিয়। পরে প্রত্যেকেই তাঁদের কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।

১৯৬৫-৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের বড় একটি সম্মেলন ছিল তিন দিনের। সারা দেশ থেকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে এসেছিল সেই কনফারেন্সে যোগ দিতে। এটা আমাদের প্রথম বড় করে শুরু ছিল বলা যায়। এই কনফারেন্সের জন্য দুটি পোস্টার করেছিলেন প্রাণেশ কুমার মণ্ডল ও নিতুন কুন্ডু। ’৬৬-তে পোস্টার করেছিলেন রশীদ চৌধুরী।

এই সম্মেলন উপলক্ষে আমাদের এক শিল্পী বন্ধু আনোয়ার হোসেনও যুক্ত হয়েছিলেন বড় একটি কাজে। আমরা ঠিক করেছিলাম, ’৫২ থেকে ’৬৫ সাল পর্যন্ত আন্দোলনের ঘটনাবলি নিয়ে শিল্পীদের ছবির একটি প্রদর্শনী করব। আনোয়ার ভাই সে সময় জয়নুল আবেদিনের কাছ থেকে ছোট ছোট কাগজে ছোট ছোট করে ড্রয়িং করিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, যেটা পরে অন্য শিল্পীরা বড় করে আঁকেন। সেগুলো ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনের ‘পোর্চে’ প্রদর্শিত হয়েছিল। জয়নুল আবেদিন বেঁচে নেই। তাঁর সেই ভূমিকা আমরা আজও স্মরণ করি।

আরেকটি বিষয় মনে পড়ে, ১৯৬৯ সালের সম্মেলনে মঞ্চের পেছনে ‘গুয়ের্নিকা’ এঁকেছিলেন দেবদাস চক্রবর্তী ও প্রাণেশ কুমার মণ্ডল। সেবার আমাদের গেট ডিজাইন করেছিলেন শিল্পী রফিকুন্নবী। সেখানেও গুয়ের্নিকার ছায়া ছিল। এ রকমভাবেই সেরা শিল্পীরা আমাদের মঞ্চ ডিজাইন করে দিতেন। এই যে সে সময়ের রাজনীতির সঙ্গে কবিতা, গান, ছবি আঁকাকে যুক্ত করা—এসবই ছিল সে সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

এভাবেই ষাটের দশকজুড়ে ঢাকাসহ সারা দেশে ছোট-বড় যত ধরনের সংগীত ও অনুষ্ঠান হতো, তাতে শুধু দেশের গান হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুল প্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম, সলিল চৌধুরী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীসহ আরও অনেকের দেশের গান গাওয়া হতো। দেশের সেরা শিল্পী শেখ লুত্ফর রহমান, আবদুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, সুখেন্দু চক্রবর্তী, অজিত রায়, জাহিদুর রহিম, ফাহমিদা খানম, মাহমুদা খাতুনসহ আরও কতজন অংশ নিতেন। নাটকে অংশ নিতেন গোলাম মুস্তাফা, হাসান ইমাম, আবুল হায়াত, আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর, ইনামুল হক, লায়লা হাসান, কাজী তামান্না প্রমুখ দেশের সেরা শিল্পীরা।

১৯৬৯ ও ’৭০ সালে আমরা দুবার দুটি বড় ব্যানার পেইন্টিং এক্সিবিশনের আয়োজন করেছিলাম—’৫২ থেকে ’৬৯ এবং ’৫২ থেকে ’৭০ পর্যন্ত গণ-আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে। অতীতের অর্থাৎ সংগ্রামের কাহিনিচিত্র নিয়ে বেশ বড় বড় সব ব্যানার চিত্র। সেগুলো শহীদ মিনারের উল্টো দিকে দেয়ালের ওপর সারি বেঁধে সাজিয়ে প্রদর্শন করা হয়েছিল।

আমার ভুল না হলে প্রথমবার আয়োজনটি করা হয়েছিল ১৯৬৯ সালে, ডাকসুর পক্ষ থেকে। কিন্তু উদ্যোগ ছিল আমাদেরই। চিত্রশিল্পী ইমদাদ হোসেন তখন থাকতেন ইন্দিরা রোডের একটি বাসায়। বিরাট একটি লন ছিল তাঁর বাড়িতে। সেখানে শিল্পীরা রাতদিন বসে কাজ করেছেন। ইমদাদ হোসেন ছাড়াও শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার, নিতুন কুন্ডু, দেবদাস চক্রবর্তী, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন্নবী প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে একদল তরুণ শিল্পীও চলে আসতেন। জমজমাট একটা আড্ডা হতো। রাতভর কাজ করে পরদিন গিয়ে শহীদ মিনারের সামনে সাজানো হতো।

দ্বিতীয় আয়োজনটি ’৭০ সালে একক দায়িত্বে করেছিল ছাত্র ইউনিয়ন। তখন তো বৃহত্তর ছাত্র ঐক্য বা সমঝোতা নেই। ইমদাদ ভাইয়ের বাসাতেই হয়েছিল কাজগুলো। ওই শিল্পীরাই এঁকেছিলেন। চিত্রগুলোর সংখ্যা আমার সঠিক মনে নেই। শুধু মনে আছে অসাধারণ সব শিল্পকর্মের কথা।

সেই ব্যানারচিত্র প্রদর্শনীটি ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। বহু ছাত্রের অংশগ্রহণে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান উপলক্ষে শহীদ মিনারে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন কিশোর শহীদ মতিউর রহমান মল্লিকের বাবা আজহার আলী মল্লিক। খুব সফল হয়েছিল ওই প্রদর্শনী ও অনুষ্ঠানটি।

ষাটের দশকে বহু সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এবং রাজপথে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পাশাপাশি দেশের সেরা কবি, গায়ক, লেখক, অভিনেতা, গল্পকারসহ সবাইকে এভাবে আমাদের সব কাজের মধ্য দিয়ে একত্র করতে পেরেছিলাম। তাঁরাও নিজ নিজ উদ্যোগে সে সময়ের সব আন্দোলন-লড়াইয়ে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। এভাবেই বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদ বিভিন্নভাবে এই সব সাংস্কৃতিক সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। এসবের মধ্যে দিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদ দেশের সেরা সংগঠনের পরিচিত লাভ করেছিল।

স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলাদেশের বামপন্থী শক্তি, বিশেষ করে ছাত্র-যুবসমাজ সব সময় চেয়েছিল জাতীয় দাবিতে ব্যাপক ভিত্তিতে ঐক্য বা সমঝোতা গড়ে তুলতে। সে জন্য পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বড়-ছোট সবকিছুতে তারা যুক্ত ছিল। বিভিন্ন প্রয়োজনে অথবা নানা সুবিধা-অসুবিধায় এই ঐক্য গঠনে ভূমিকা রেখেছে এবং অন্য সবাইকে যুক্ত করার চেষ্টা করেছে। এটা যেমন ’৫২-৫৩ সালের জন্য সত্য, ’৫৯-৬০ বা ’৬১ সালের জন্যও সত্য। আর ’৬২ সালের পরের বছরগুলোতে এই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা বেড়েছিল আরও বহুগুণ।

ষাটের দশকের সেই সময়, সেই সব দিনগুলি-রাতগুলির কথা যখন মনে পড়ে, তখন একদিকে যেমন তুমুল আশা-উদ্দীপনার কথা মনে হয়, একই সঙ্গে পঞ্চাশ বা বায়ান্ন বছর পরে এসে মনে হয়, সেসব সময়ের অনেক আশাবাদী সম্ভাবনা বাস্তবে পরিণত না হয়ে অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তবু সেই আশা ও উদ্দীপনা নিয়েই আমরা বেঁচে আছি। এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারি বছরের পর বছর ধরে আমাদের ডাক দিয়ে যায়, জাগিয়ে তোলে। কিন্তু আমরা কতটা জাগ্রত হই?

আগেই বলেছি, দিনরাত এক করে ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের এই সংকলনের কাজগুলো আমরা করেছি। আজ যখন সংকলনগুলোতে আবার চোখ বোলাই, মনে হয়, কিছু অপূর্ণতা রয়ে গেছে। যেমন ঝড়ের খেয়া সংকলনে ‘একুশের শপথ’ আমার নিজের হাতে লেখা। লেখাটি টাইপে বসানো যেত। এমন করে সবটা হয়তো তখন ঠিক পরিকল্পিতভাবে হয়ে ওঠেনি। 

আমাদের দুচোখভরা ছিল স্বপ্ন। সে স্বপ্ন এখনো মলিন হয়নি। সেসব স্মৃতি এখন আনন্দ দেয়, উত্সাহিত করে। আসলে সেই সময়গুলো আমাদের বর্তমান ও পূর্ববর্তী প্রজন্মের জন্য হয়ে আছে এক সেরা সময়ের ইতিকথা। সেই সেরা সময়গুলোকে এক মলাটে আনতেই ‘বিদ্রোহী বর্ণমালা’র উদ্যোগ। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের এক উত্তাল সময়ে আমাদের তারুণ্য ও যৌবনের সেই স্বপ্নের পাশাপাশি সে সময়ের সেরা মানুষগুলোর যাত্রা ও উত্থানের সাক্ষ্য এ বই।

সবকিছুই আমি সযত্নে গুছিয়ে রাখতে চাই। তবু হয় না। গুরুত্বপূর্ণ কত কিছু যে হারিয়ে ফেলেছি! এত দিন ধরে আগলে রাখার পরও সংকলনগুলোর মধ্যে একটি সংখ্যা (‘বিক্ষোভ’, ১৯৬৫) আজ আর আমার কাছে নেই। এই একটি সংকলন হারিয়ে ফেলার কারণেই হয়তো উপলব্ধি করি, আরও আগেই বই করে এগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করা উচিত ছিল। আমাদের স্বপ্ন ও ভালোবাসার এই সংকলনগুলো তরুণ কোনো গবেষকের জন্য মূল্যবান দলিল হয়ে উঠতে পারে।

বিদ্রোহী বর্ণমালার কাজ করতে গিয়ে নানাজনের সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে শিল্পী বন্ধু অশোক কর্মকারের ভূমিকার কথা বলতেই হয়। পুরো বইয়ের পরিকল্পনা, অঙ্গসৌষ্ঠব ও প্রচ্ছদ তৈরিতে নিজে আগ্রহী হয়ে কাজ করেছে সে। ধন্যবাদ প্রাপ্য সহকর্মী রাসেল রায়হানের। সে পুরোনো সংকলনগুলো দেখে দেওয়াসহ বইয়ের সার্বিক পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। ধৈর্য ধরে বইয়ের কম্পিউটার বিন্যাস করে দিয়েছেন মো. ফারুক আহমেদ। যত্নসহকারে বইটি প্রকাশে সাহায্য করেছেন হুমায়ুন কবির। তাঁদের কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলাম।

বিদ্রোহী বর্ণমালার বানানের ক্ষেত্রে প্রথমার ভাষারীতি অনুসরণ করা হয়েছে। তবে সংকলনগুলো যেভাবে ছাপা হয়েছিল, সেভাবেই হুবহু ছাপা হয়েছে। আলাদা করে কোথাও কোনো সংশোধন বা পরিবর্তন করা হয়নি। এ কারণেই একেকটি সংকলনের অঙ্গসজ্জা একেক রকম মনে হতে পারে।

বইয়ে ব্যবহৃত প্রতিটি অলংকরণই সংশ্লিষ্ট সংকলন থেকে নেওয়া। এত কিছুর পরও বড় একটি কাজে ভুলত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। বিষয়টি পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন—এ প্রত্যাশা করি।