দেশের অগ্রগতির জন্য নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি জরুরি

২০০৮ সালের ২ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টায় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার গ্রামীণফোন লিড নিউজ অনুষ্ঠানে ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমানের সাক্ষাৎকার সরাসরি প্রচারিত হয়। সাক্ষাৎকার নেন এটিএন বাংলার প্রধান বার্তা সম্পাদক জ. ই. মামুন। অনুষ্ঠানের কথোপকথন হুবহু ছাপা হলো।

জ. ই. মামুন: প্রিয় দর্শক, আপনাদের সবাইকে অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি আমাদের প্রতি রাতের নিয়মিত অনুষ্ঠান গ্রামীণফোন লিড নিউজ। আজকে এ অনুষ্ঠানে আলোচনার জন্য উপস্থিত আছেন দৈনিক ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমান। আপনারা জানেন যে এ অনুষ্ঠানে আমরা দিনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি। নতুন বছরের শুরুতে গত কয়েক দিন এবং আগামী কয়েক দিনও আমরা গত বছরটি কেমন গেল এবং আগামী বছরটি কেমন দেখতে চাই, এসব বিষয় নিয়েই কথা বলব মূলত।

মতি ভাই, আমরা আসলে সরকারের এক বছর নিয়ে কথা বলব। তার আগে একটু চালের দাম প্রসঙ্গে আসতে চাই। আপনি জানেন, গতকাল খাদ্য উপদেষ্টা বলেছিলেন, চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছুই করণীয় নেই; আজকে আবার অর্থ উপদেষ্টা বললেন—না, করণীয় আছে, আমরা করছি ইত্যাদি। একদিকে চালের দাম বেশি, অন্যদিকে সরকারের এ রকম দুই ধরনের বক্তব্য—এটি কি সরকারকে একটু নাজুক অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে না?

মতিউর রহমান: শুধু চাল নয়, সামগ্রিকভাবে চাল, তেল, গম ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, এটা একটা দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে সর্বস্তরের মানুষের জন্য। এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের অনেক সফলতা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা ব্যর্থ হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, চালের দাম এভাবে বেড়ে যাবে—এটা তো অজানা ছিল না, এটা তো তাঁরা জানতেন। বাজারের অবস্থা তাঁরা বুঝতে পারেন।

আমার মনে হয়, কোথাও এ সরকারের বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটা রক্ষণশীলতা আছে, একটা দুর্বলতা আছে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটা তাঁরা নিতে পারছেন না।

গতকাল উপদেষ্টা বলেছিলেন এক কথা—সরকারের কিছু করার নেই। আজকে বলছেন—না, সরকারের কিছু কাজ আছে। আজকে সারা দিন মিটিং হয়েছে বিভিন্ন দপ্তরে, মন্ত্রণালয়ে, সচিবালয়ে; এবং তাঁরা ঠিক করেছেন, চালের আমদানির উদ্যোগ বাড়াবেন। তাঁরা খোলাবাজারে চাল বিক্রি করবেন। এই যে কাজটা, এটা আগেও হতে পারত। আমরা বলব, আসলে কয়েক মাস ধরেই কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বা বিডিআরের পক্ষ থেকে চাল ও অন্যান্য জিনিস বিক্রি করার উদ্যোগ আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁরা বেশি সফল হতে পারলেন না; বরং সংকট এখন বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে।

 

মামুন: এ পরিস্থিতিটা কি সরকারকে একটু নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে না?

মতিউর: অবশ্যই, এমনও তো আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আজকে যদি তাঁরা চেষ্টা করেন, উদ্যোগ নেন, এক-দুই মাস লাগবে চাল এসে পৌঁছাতে। যদিও তাঁরা বলছেন, চট্টগ্রাম, ঢাকা, পেট্রাপলে চাল এসে পৌঁছেছে; কিন্তু তা সেখান থেকে আনতে, বিলি করতে সময় লাগবে; এবং অনেক চাল লাগবে। হতে পারে সাত লাখ টন, হতে পারে ১০ লাখ টন, বা আরও বেশি। এই ব্যবস্থাপনাটা তো খুব সহজ নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ বা আমরা বলতে পারি, সচিবালয়, বা যাদের দায়িত্ব সরাসরি, তারা এই কাজগুলো সম্ভবত করতে পারছেন না। সেদিক থেকে আমরা বলব, এক বছর পর সরকার সত্যিকার অর্থেই একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ও বিপদের মুখে পৌঁছে গেছে।

 

মামুন: আরেকটি প্রসঙ্গ আপনি আজকের সংবাদ শিরোনামে দেখেছেন—শেখ হাসিনা অসুস্থ, কারাগারে অন্তরিন অবস্থায়। সে ক্ষেত্রে কথা উঠেছে যে বিদেশে পাঠানো যাবে কি না। কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে, প্রচলিত আইনে সেটি সম্ভব নয়। কিন্তু আইন উপদেষ্টা বলেছেন, আবেদন করা হলে সেটি বিবেচনা করা হবে। এটার সঙ্গে যে আরও বিষয় জড়িত, পত্রিকায় রিপোর্ট এসেছে, টেলিভিশনে এসেছে, দুই নেত্রীকে আবারও বিদেশে পাঠানোর একটি সমঝোতা প্রস্তাব হয়তো গোপনে এর পেছনে থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে আপনার কী মনে হয়?

মতিউর: দেখুন, উপদেষ্টাদের বিভিন্ন আলোচনা, বক্তব্য, মতামত একটা বড় রকমের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা সাংবাদিক হিসেবে বিভিন্ন মহলের খোঁজখবর রাখার উদ্যোগ নিই, ভাবি বা চেষ্টা করি। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত শুনিনি, অসুস্থ দুজনকে বা একজনকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা বা সম্ভাবনার কথা কোথাও আছে। আমরা যতটুকু বুঝি, জেলকোড বা আইনে তাঁদের বাইরে পাঠানোর কোনো সম্ভাবনা বা সুযোগ নেই। তারপর, আপনি যেটা বললেন, কোনো রাজনৈতিক আলোচনা বা সমঝোতা যদি হয়ে থাকে, তো এই সরকার আসার পর থেকে আমাদের জানামতে, একাধিকবার দুই নেত্রী বা দুই দলের নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতা চেষ্টার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; সেটা সফলকাম হয়নি। আর আজ এত দিন পর, এক বছর পর এসে এখন সফল হবে, সম্ভাবনা থাকবে—এটা এখনই আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। বা, সরকারের মধ্য থেকে এমন কোনো ধারণা আমরা পাইনি যে এ রকম কোনো উদ্যোগ তাঁদের মধ্যে আছে।

 

মামুন: কিন্তু সে ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়, আইন বা তথ্য—এতগুলো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ একজন উপদেষ্টা যখন টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে, সাংবাদিকদের সামনে এ কথা বলেন, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ভিত্তি থাকে। সেটি কী হতে পারে?

মতিউর: না, দেখুন আপনি, তপন চৌধুরী এক কথা বলেছেন, আজকে মির্জ্জা আজিজ অন্য কথা বলেছেন; এবং আজকে তাঁরা বেশ উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন। এটাও তো প্রমাণ করে যে সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে সমন্বয়, ভাবনা-চিন্তার সামঞ্জস্যের অভাব রয়েছে। বিগত এক বছরে অনেক বক্তব্য শুনলাম, অনেক মন্তব্য শুনলাম—যেগুলোর পরে কোনো ভিত্তি খুঁজে পাইনি। সেদিক থেকে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়াটা বোধহয় সরকারের জন্য বিব্রতকর। দেশের মানুষের মধ্যে এটা প্রচণ্ড বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।

 

মামুন: এখন যদি আমরা সামগ্রিকভাবে জানতে পারি যে গত এক বছরে বিশেষ করে ১১ জানুয়ারি পর গত সরকার যখন ক্ষমতায় এল, এই এক বছর আমরা কতটুকু অর্জন করলাম? আমরা জানি যে আমাদের মূল লক্ষ্য নির্বাচন। সে নির্বাচনের দিকে যাওয়ার জন্য অনেক রকম পথ পরিষ্কার করতে গিয়ে সংস্কার, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, মাঠপর্যায় পার হয়ে এসেছি আমরা। এ পর্যায়ে এসে এখন আপনার কাছে কী মনে হয়?

মতিউর: এক বছর আগে যে অবস্থা ছিল, আজকে এক বছর পর অনেক অগ্রগতি আমরা লক্ষ করছি—বিশেষ করে নির্বাচনের ক্ষেত্রে। কারণ, নির্বাচন যদি হতে হয়, তাহলে একটি সুষ্ঠু ভোটার তালিকা লাগবে। ভোটার তালিকা এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ চলছে। আমি বলব, এগুলো সঠিকভাবে এগোচ্ছে। এগুলোর যে সময় নির্ধারিত ছিল, তার আগেই এটা হয়ে যাবে। যদি হয়ে যায়, এটি একটি বড়ো কাজ হবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন একাধিক প্রস্তাব এনেছে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং আরও অন্যান্য দিক থেকে। এ প্রস্তাবগুলো ভালো। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের তারিখটা যদি চূড়ান্ত করতে পারে, তবে ভালো। আরেক ধাপ অগ্রগতি হবে।

আমরা বলতে চাই, এত কিছুর পরও কিন্তু মানুষের মধ্যে নির্বাচন হওয়া নিয়ে, নির্বাচনের সম্ভাব্যতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন বা দুশ্চিন্তা আছে। এ সম্পর্কে আমরা সঠিক বলতে পারব না। তো, আমাদের মনে হয়, এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বা অন্য উপদেষ্টাদের আরও প্রকাশ্য বক্তব্য দেওয়া দরকার। মানুষকে আস্থায় নেওয়া, তাদের সঙ্গে আলোচনা করা, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এটাকে বারবার প্রচার করা—এটা একটা জরুরি কাজ তাদের থাকছে। আর, এরই সঙ্গে কিন্তু এই এক বছরে, ধরুন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠন বা এ ধরনের আরও বেশ কিছু কাজ কিন্তু হয়েছে। আরও অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, পুলিশ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন হচ্ছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার ও বিচারের কাজ চলছে। তো, আমরা বলব, একটি দিক থেকে আমরা খুব পিছিয়ে গেলাম যে সরকারের প্রশাসনে বা সচিবালয়ে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। আসলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিগত সরকারের যে প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল, তা-ই রয়ে গেছে। এই প্রশাসন ব্যবস্থাকে দিয়ে এত বড় সংস্কার, ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন—এগুলো তো করা সম্ভব নয়। সেখানে একটা বড় সংকট রয়েছে। আমরা মনে করি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভেতরে, উপদেষ্টাদের মধ্যে, সচিবালয়ের ভেতরে সমস্যা রয়েছে—সমন্বয় এবং চিন্তার, ঐকমত্যের, কাজে গতি নিয়ে আসার, উদ্যোগ নেওয়ার, প্রকাশ্যে মানুষকে সবকিছু অবহিত করার এবং মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির একটা চেষ্টা থাকা দরকার।

 

মামুন: এ পর্যায়ে একটি প্রশ্ন আমি আপনাকে করতে চাই; সেটি হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে বা মানুষের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কখনো এর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি এবং আসল পরিস্থিতিটা কী, সেটাও জানানো হয়নি। এ ক্ষেত্রে কি আপনার মনে হয় যে উপদেষ্টা যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে এক বা একাধিক কেউ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে রয়েছেন? সরকার নিজেই কোনো কোনো উপদেষ্টাকে নিয়ে বিব্রত—এমন কি মনে হয় আপনার?

মতিউর: সামগ্রিকভাবে সরকারের অবস্থানটা এ মুহূর্তে বেশ বিব্রতকর। আর আমরা একটি কথা আপনাকে বলতে চাই, এই বিরাট পরিবর্তনের পর গত ১৪ জানুয়ারি (২০০৭ সাল) আমাদের ‘প্রথম আলো’য় একটি মন্তব্য প্রতিবেদন আমরা প্রকাশ করেছিলাম যে—‘ড. ফখরুদ্দীনকে শুভেচ্ছা। উপদেষ্টাদের তালিকা উত্সাহজনক নয়’। আমরা মনে করি, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। এই দশজন উপদেষ্টার যে সমবেত শক্তি, যে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল, সেটা তাঁরা করতে পারেননি। এবং সেটাই আজকে দেশের সব সমস্যার একটি বড় কেন্দ্র বা জায়গা। এখানে পরিবর্তন না হলে আগামী এক বছর সময়ের মধ্যে আমাদের যেসব ভাবনা-চিন্তা-কাজ করার আছে; আমাদের সমাজ, সচিবালয়, প্রশাসন বা সরকারকে দিয়ে সেগুলো করা সম্ভব নয়।

সে জন্য আমি বলব, ১১ জানুয়ারি এসে গেছে, তার আগে অবশ্যই প্রধান উপদেষ্টা উপদেষ্টা পরিষদকে পুনর্গঠন করবেন। নতুন লোক নিয়ে আসবেন, যাঁরা বর্তমানে জটিল ও কঠিন সময়ের কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। বিশেষ করে এখন পর্যন্ত উপদেষ্টা পরিষদ বা সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা বা যোগাযোগ করেনি। একটি বছর পার হয়ে গেছে। রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁদের যদি যোগাযোগ না হয়, তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আমরা বলব, দ্রুত এ উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করা হবে এবং তারা উদ্যোগী হয়ে রাজনৈতিক দল ও অন্যদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে; এবং এটা বর্তমান পরিস্থিতিতে এ অবস্থার উন্নতিতে সহায়ক হবে। গতকাল আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান কিন্তু একটি ভালো কথা বলেছেন। তিনি উপদেষ্টা পরিষদকে বলেছেন, রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে; এবং সে আলোচনায় দেশের দ্রব্যমূল্যসহ অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আমরা মনে করি, সরকারের জন্য এটাও একটা সুযোগ।

 

মামুন: এখানে একটি প্রসঙ্গ আসে যে অনেক দিন ধরে শুনছিলাম, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল একটি জাতীয় সরকারের আলোচনা। সে ক্ষেত্রে আপনার কি মনে হয় যে এ সরকারের অধীনে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করেই নির্বাচনে যাওয়া উচিত? নাকি, জাতীয় সরকারের ফর্মুলার ভেতর দিয়ে যাওয়া উচিত?

মতিউর: দেখুন, এক বছর হয়ে গেছে; এবং এই বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ দায়িত্ব নিয়ে যে সব বক্তব্য দিয়েছিলেন, যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। জাতি আজ অপেক্ষা করছে, আমরা সবাই অপেক্ষা করছি যে একটি সুষ্ঠু ভোটার তালিকা তৈরি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার পর একটি নির্বাচন হবে। এখান থেকে ফিরে যাওয়াটা কিন্তু মোটেই মঙ্গলজনক হবে না—আমাদের দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য। জাতীয় সরকার হওয়া মানে এটাকে আরও দীর্ঘায়িত করা, একটা লম্বা সময় দেওয়া। আমরা মনে করি, দেশের মানুষ, বা আমাদের যারা বন্ধুবান্ধব, আন্তর্জাতিক শক্তি যারা আছে—কেউ এটা মানতে পারবে না। তাই আমরা বলি, সরকারের একটাই কাজ— রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা। নির্বাচন ঠিক সময়ে হয়ে যাওয়া, সম্ভব হলে আরও আগে।

 

মামুন: আপনি একটু আগে বলছিলেন যে সরকার চাপের মুখে বা কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায়; এর পেছনে একটি কথা শোনা যায় যে সরকার একসঙ্গে অনেক বেশি কাজ হাতে নিয়েছিল। আপনি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন?

মতিউর: আমরা একদিকে বলব, ‘হ্যাঁ’; আবার অন্যদিকে বলব ‘না’। কারণ, একটি সরকার যখন তিন মাসের সীমা পেরিয়ে গিয়ে তারা দায়িত্ব নিল এবং দেশের সামনে অনেক সমস্যা ছিল। আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলো দেশকে এমন সংকটে ফেলে গেছে যে আপনি কেবল একটি করবেন, আরেকটি করবেন না, এটা সম্ভব নয়। আজকে দেখলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা গ্রেফতার হয়েছেন। দুর্নীতি সীমাহীন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। আপনি বলতে পারেন, অনেকেই বলছেন, বেশি হয়ে যাচ্ছে। আড়াইশ সংখ্যা বেশি বলব কেন, বেশি বলতাম, এটা যদি পাঁচ হাজার, ১০ হাজার হতো। অবশ্যই ৩০০ সাংসদের অনেকেই দুর্নীতি করেছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আছেন; রাজনীতিবিদদের মধ্যে, সমাজের সর্বস্তরের মধ্যে এগুলো আছে। তাঁদের অনেককে শাস্তি দেওয়া, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠন, পিএসসি পুনর্গঠন, অন্যান্য রেগুলেটরি কমিশন করার, সচিবালয়, আরও অসংখ্য কাজ—এগুলো না করে নির্বাচনে যাবে, সেই একই দুর্নীতি, সেই দলীয়করণ থাকে তাহলে তো আমাদের কিছু লাভ হলো না। এসব কারণে হয়তো তারা কিছু কাজ বাড়িয়ে নিয়েছেন এবং বাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তা করার মতো অবস্থা সৃষ্টি করতে পারেননি।

 

মামুন: এই যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রসঙ্গে আপনি বললেন, আমরা তো দেখেছি যে, রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশ জেলখানায়। ব্যবসায়ীদের নিয়ে তো সরকার একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছিল। ব্যবসায়ীদের ধরে পরে আবার তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বলা হলো, ট্রুথ কমিশন ইত্যাদি করা হবে। আবার অনেককে আমরা দেখলাম যে, বের হয়ে আসছেন। এটা কি সরকারের এক ধরনের পিছু হটা নয়?

মতিউর: দেখুন, একটি বড় কাজ করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়ে যদি কিছুটা পিছিয়ে আসে এটাকে আমরা কোনো অন্যায় বলব না। ইতিমধ্যে তারা মাত্র দুজনকে মুক্তি দিয়েছে। কী শর্তে, এটা আমরা জানি না। কিন্তু যেসব ব্যবসায়ীকে ধরা হয়েছে, আমরা তো ২০-২৫ বছর ধরে এঁদের বিরুদ্ধে আমরা লিখেই চলেছি। অনেক তথ্য প্রকাশ হয়েছে। মানুষ সব জানে। এ জন্য যে ব্যবসায়ী নেতা বা যে ব্যবসায়ীকে বা রাজনৈতিক নেতাকে ধরা হয়েছে—এ ব্যাপারে কি খুব বেশি আপত্তি সমাজে আছে?

 

মামুন: না, তা নেই।

মতিউর: অর্থা, তাঁরা দুর্নীতিপরায়ণ। এঁরা যে দুর্নীতি করেছেন, এর স্বীকৃতি কিন্তু সমাজে আছে। এখন সামনে নির্বাচন, সরকার একটি বড় সংকটে পড়ে গেছে। যদি সমঝোতা করতে হয়, সাময়িক, এটা তাঁরা ভাববেন।

 

মামুন: যাঁদের ধরা হয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে কারও আপত্তি নেই এটা যেমন সত্যি, যাঁদের অনেককে ধরা হয়নি তাঁদের ব্যাপারেও প্রবল আপত্তি আছে—এটাও তো সত্যি। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?

মতিউর: আপনি তো বললেন, সব তো একসঙ্গে করা সম্ভব নয়। আমরা যত দূর জানি ৪২০ জনের তালিকা হয়েছিল। তাঁদের ধরবে, বিচার করবে। এখন তাঁরা ২২০-৩০-এর মধ্যে হয়তো আছেন। এটুকু করা কিন্তু যথেষ্ট কঠিন। সে জন্য একটি মত আছে যে, দৃষ্টান্তমূলক বা যাঁরা দুর্নীতির দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন— যেমন, বসুন্ধরার আহমেদ আকবর সোবহানের সঙ্গে হত্যার দায় থেকে তার ছেলেকে মুক্ত করার জন্য ১০০ কোটি টাকার লেনদেন নিয়ে আলোচনা হয়েছে তারেক-বাবরের সঙ্গে। ৫০ কোটিতে সমঝোতা হয়েছে। ২১ কোটি দিয়েছে। এগুলো তো অসম্ভব ব্যাপার। এগুলোর তো বিচার হতেই হবে। বিশেষ করে সরকারের দায়িত্ব, তাদের আগামী এক বছরের কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে হলে, কতটুকু পারবে, কতটুকু পারবে না—সেটুকু ঠিক করে নেওয়া। কোনো আপত্তি নেই, তারা যদি নির্ধারণ করে, ২৪০ জন আছে, ২২০ জন আছে, ১০০ জনেরটা দেখব—হতে পারে ১২০ জন। ভবিষ্যতে যে সরকার, যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের দায়িত্ব হবে বাকি কাজগুলো করা।

 

মামুন: আরেকটি বিষয়, রাজনৈতিক দলের সংস্কার। গত ১ বছরে রাজনৈতিক দলের সংস্কার নিয়ে অনেক কথা আমরা শুনেছি। অনেক নাটক আমরা দেখেছি। কিন্তু আমরা এখন ১১ জানুয়ারির থেকে এক বছরের মাথায় এসে আপনার কাছে কি মনে হয়, যে সংস্কারের কথা আমরা শুনছি সেটি কি আসলেই সংস্কার, নাকি লোক দেখানো একটা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কৌশল?

মতিউর: দেখুন, আমরা কিন্তু এক বছরের কথা বলি না। পাঁচ বছর আগে বা আমরা বলতে পারি, যেদিন ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফল হলো, বিএনপি সরকার গঠন করতে যাচ্ছে; সেদিন বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা, একইদিনে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা আমাকে বলেছিলেন, ‘দুই নেত্রীর অধীনে দেশে গণতন্ত্রের কথা ভুলে যান’। আজকে তাঁরা এসে অনেক কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁরা কী কী চান। একজন, একনায়কত্বের অধীনে তাঁরা থাকতে চান না। তাঁরা একজনকে দুবারের বেশি পদে দেখতে চান না। একইভাবে বিএনপির পক্ষ থেকে একই রকম কথা বলা হয়েছে। আবদুল মান্নান ভূঁইয়াও বলেছেন। কিন্তু তাঁরা সেগুলো থেকে পিছিয়ে গেছেন। তাঁরা ভয় পেয়েছেন। তাঁদের দলীয় কাঠামোর অবস্থান যা, তাতে তাঁরা মনে করেছেন যে এগুলো দিয়ে তাঁরা সামনে এগোতে পারবেন না। এটা তাঁদের ভীতি, তাঁদের ভয়।

আজকে দেশ যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, দুই দলের নেতৃত্ব যা করেছেন—এই দল যদি তাদের মধ্যে পরিবর্তন না আনে এবং নেতৃত্ব সংগঠন, অর্থ ব্যবস্থাপনা, কমিটি গঠন, দলের মনোনয়ন পদ্ধতির পরিবর্তন না আনে, নির্বাচন হোক না হোক, আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ আছে? এটা অবশ্যই হতে হবে, হওয়া উচিত।

 

মামুন: অবশ্যই উচিত। আমরা সবাই তা-ই তো মনে করি। সেটার জন্য তো এত কথা, মানে ১১ জানুয়ারির পটভূমি রচিত হলো। গত ১ বছরে দলগুলো নিজেদের কতটুকু প্রস্তুত করতে পেরেছে?

মতিউর: আমি বলব, তাঁরা ব্যর্থ হয়ে গেছেন। তাঁরা করতে চান না, তাঁরা ভয় পান। তাঁরা বিভিন্নভাবে দুর্নীতিতে যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের সেই মনোবল, মানসিক শক্তি নেই। তাঁরা তাই এখন উদ্যোগ নিতে পারেন না।

 

মামুন: যে সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল, সেই বিএনপি-জামায়াতের কথাই যদি ধরেন, আপনার মূল্যায়নে বিএনপির অবস্থানটা কোথায় এখন?

মতিউর: আমাদের তো এটা ভাবতে অবাক লাগে যে এক অংশের নেতা সাইফুর রহমান আরেক অংশের নেতা খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। দুর্নীতিবাজ হিসেবে তাঁরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একজনের পরিবারের মধ্যে প্রায় সব সদস্য এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁরা জেলে গেছেন, তাঁরা পালিয়ে গেছেন দেশ থেকে। আরেকজনের দুই সন্তান পালিয়ে বেড়ান, একজন জেলে আছেন। তো এ রকম দলের নেতা দিয়ে, দল দিয়ে আমরা কী ভাবব? আর যে দলের নেত্রীর অনুমতিতে তাঁর ছেলে, তাঁর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ১০০ কোটি টাকা দাবি করেন, ৫০ কোটিতে সমঝোতা করে ২১ কোটি টাকা নিয়ে নেন; এই দল করতে যে নেতারা চিন্তা করেন, আমাদের তো লজ্জা লাগে। এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। এই দুর্নীতি, অপমান, লজ্জা—এটা পুরো জাতির।

 

মামুন: অন্যদিকে আওয়ামী লীগ...

মতিউর: আমি মনে করি যে একটা আমলে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, অবশ্যই আওয়ামী লীগ নেতারা, মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য বিভিন্নভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এমনকি ২০০৭ সালের জানুয়ারির মনোনয়নের সময় দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা, আমরা বলব, শেখ হাসিনার জানামতে, তাঁর আত্মীয়স্বজন, তাঁর বন্ধুরা, তাঁর দলের নেতারা অর্থ নিয়েছেন। শুধু আওয়ামী লীগের দলের ভেতর থেকেই নয়, অন্য দলের প্রার্থীদের মনোয়ন দিতে, এমনকি মৌলবাদী প্রার্থীর কাছ থেকেও তাঁরা টাকা নিয়েছেন। তো এ রকম দল, এ রকম নেতৃত্ব—যাঁরা এভাবে মনোনয়নের জন্য দলের ভেতরে অর্থ সংগ্রহ করেন, এসব দল নিয়ে আমরা কী ভাবব? আমরা মনে করি, অবশ্যই এর পরিবর্তন হতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে।

 

মামুন: বাংলাদেশের বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাদ দিয়ে তো নির্বাচন করা সম্ভব নয়।

মতিউর: সেটা ঠিক। আমরা আশা করি, নির্বাচন হবে, তারা নির্বাচন করবে।

 

মামুন: কিন্তু সেক্ষেত্রে এই অল্প সময়ের মধ্যে, এই এক বছর আমাদের নেই— সামনে বাকি আছে ৯-১০ মাস, সর্বোচ্চ ধরেন ১১ মাস। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিকে কিভাবে আমরা বিশুদ্ধ করব? পরিশুদ্ধ করব?

মতিউর: এটা সম্ভব নয়। এটা আমার-আপনার কাজ নয়। আপনাকে-আমাকে দিয়ে এটা সম্ভবও নয়। তো আমরা প্রচার করব, আমাদের কথা আমরা বলতে থাকব। যদি কখনো দলের নেতৃত্বের মধ্যে, কর্মীদের মধ্যে, মানুষের মধ্যে বোধোদয় হয়। না হলে এই নিপীড়ন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, কালো টাকার মালিকদের অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্যে আমাদের থাকতে হবে। আর তো কিছুই করার নেই আমাদের।

 

মামুন: এটা তো হতাশাব্যঞ্জক...

মতিউর: এটা তো হতাশারই কথা। গত এক বছরে যা দেখলাম, রাজনৈতিক দলের যে ভূমিকা, অবস্থান, বক্তৃতা-বিবৃতি—তাঁরা এখন আন্দোলন করবেন। এটা তো হতাশ হওয়ারই কথা। কোনো রকম বোধোদয় নেই। যতটুকু যা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নেতারা বলেছেন, সেটা থেকে তাঁরা পিছিয়ে গেছেন। এর মধ্যে আপনি আর কী আশা করবেন?

 

মামুন: আরেকটি দলের কথা আরেকটু বলা দরকার, সেটি হলো জামায়াতে ইসলামী। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সব দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা কারাগারে অথবা তালিকাভুক্ত। জামায়াতের ব্যাপারে, এ রকম কোনো তালিকাতেও তাঁদের কোনো নাম নেই। তাঁদের সম্পত্তির হিসাবও চাওয়া হলো না। এবং অনেকের ধারণা, সরকারের এক ধরনের পরোক্ষ সহানুভূতি জামায়াতের প্রতি রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন?

মতিউর: দেখুন, যদি ভুল না হয় জামায়েতে ইসলামীর পাঁচ-ছয়জন দলীয় সাংসদ গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা কারাগারে আছেন। এই হলো একটা দিক।

আমি একটি কথা বলব এখানে, কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে আপনার কাছে তা জানি না। যে সরকার সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল, তার মধ্যে দুজন মন্ত্রী ও আর দুটি মন্ত্রণালয় সুস্থ-স্বাভাবিক, দুর্নীতিমুক্ত ছিল—এটা তো ভাবা খুব কঠিন। এ ছাড়া আমাদের কাগজেও প্রতিবেদন ছেপেছি যে নিজামী, মুজাহিদ বিশেষ কারণে তাঁরা জমি পেয়েছেন। শুনেছি তাঁরা দ্রুত বাড়ি তৈরি করছেন। তাঁদের একাধিক গাড়ি আছে। এগুলোর সূত্র কী? তাঁরা যদি বলেন যে দলীয় সূত্রে, যদি বলেন যে তাঁদের আয় থেকে, তাহলে সেটাও তাঁদের প্রকাশ করতে হবে।

আমরা জানি, এ প্রশ্নটিও তো মানুষের মধ্যে আছে। সে জন্য আপনি যে প্রশ্নটি করলেন, এ রকম একটি আবহ বা আলোচনা সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে আছে। আমরা মনে করি, এটা বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্ব—এ ব্যাপারে তাদের ব্যাখ্যা দেওয়া।

 

মামুন: শেষ প্রশ্ন আপনার কাছে। আপনি জানেন যে এই ১১ জানুয়ারি সৃষ্টিতে এবং দেশের এই পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকাটির মূল্যায়ন আপনি কীভাবে করবেন? এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনের পর সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হতে পারে?

মতিউর: দেখুন, সেনাবাহিনী একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমরা যদি বলি যে তারাই মূল উদ্যোগ নিয়েছে, সেটাও হয়তো সত্য হবে। এবং অনেক পরিবর্তন, অনেক ঘটনা, অনেক উদ্যোগ নিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সেনাবাহিনী মিলে। যদিও আমরা এটা বলতে পারি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সেনাবাহিনী; সেনাবাহিনী-তত্ত্বাবধায়ক সরকার মিলেমিশে কাজ করছে এবং তারা একটি বড় কাজ করছে।

কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে, আমাদের উপমহাদেশে, বিশেষ করে পাকিস্তানে, বিশ্বব্যাপী একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, সেনা শাসন, সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিন দেশ পরিচালনা করার ফলাফল শেষ পর্যন্ত সে দেশের জন্য, সেনাবাহিনীর জন্য শুভ হয় না। এটা কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তাই আমাদের কথা হলো, তারা বাংলাদেশে এই পরিবর্তনে যুক্ত হয়েছে। আমরা তাদের ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়েছি। তারা নানা উদ্যোগ, নানা চেষ্টা, নানা কাজ করছে। কিন্তু আজকে নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচনের অবস্থা সৃষ্টি করা, নির্বাচন করে দেওয়া—এ পর্যন্ত তাদের এই ভূমিকাটা থাকবে। কিন্তু আমরা তারপরও বলব যে সেনাবাহিনী যদি এই কাজ, এই দায়িত্ব শেষ করে দিয়ে স্বকাজে ফিরে যায়, তারা দেশের ভেতর, উপমহাদেশে, বিশ্বব্যাপী তারা সমাদৃত হবেন, প্রশংসিত হবেন। কারণ, এ রকম নজির কিন্তু বিশ্বের কোথাও নেই যে সেনাবাহিনী এসেছে আবার ফিরে গেছে।

আমরা মনে করি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামনে এটা বিরাট সুযোগ এসেছে, তাদের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করার জন্য। সেই উদ্যোগ ও চেষ্টা যদি বর্তমান সেনাবাহিনী গ্রহণ করে, আমরা সেটার অবশ্যই শুভ কামনা করব। তো একটা কথা আমাদের মনে হয়, নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সশস্ত্র বাহিনী, রাজনৈতিক শক্তি, রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, লেখক-শিল্পী, সংস্কৃতিজীবী, প্রচারমাধ্যম—সবার মধ্যে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সৃষ্টি করতে হবে। দেশটা আগামীতে কীভাবে চলবে, পরিবর্তনগুলো অপরিবর্তনীয় থাকবে, আমাদের নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন আগের জায়গায় ফিরে যাবে না এবং সেই রক্ষাকবচ করার জন্য একটা জাতীয় ঐকমত্যের সৃষ্টি না করলে এই দেশ সামনে এগোতে পারবে না।

 

মামুন: আর সে জন্য সংলাপটাই হচ্ছে প্রধান বিষয়...

মতিউর: অবশ্যই। আমরা মনে করি, এটা দ্রুত করা দরকার। এটা জরুরি হয়ে উঠেছে। এখনই শুরু করা দরকার।