স্টোরি অব এ রিয়েল ম্যান

সেদিন বুধবার, ১৬ মার্চ, ১৯৮৮ সাল। কলকাতাজুড়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অফিসফেরত মানুষের দারুণ ভিড় তখন পার্ক স্ট্রিট আর সার্কুলার রোডের ক্রসিংয়ে। ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি আর মানুষের গাদাগাদির মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে। রাস্তা পার হব। আমার ভেতরে তখন ঈষৎ এক কম্পন।

আমি একা নই। আমার সঙ্গে একজন—যাঁর সঙ্গে সেদিন দুপুরেই সরাসরি পরিচয়, যদিও তাঁকে আমি জানি দীর্ঘদিন—তিনি দুই ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। তিনিও কলকাতার সন্ধ্যার ওই ভিড় অগ্রাহ্য করে রাস্তা পার হবেন। আমরা যাচ্ছি রাস্তার ওপারের এক স্টুডিওতে তাঁর ছবি তুলতে। আমি তাঁর একটি ছবি রাখতে চাই।

তিনি নূরুন্নবী, বাঁ পা ঊরু থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে সেই কবে, আটত্রিশ বছর আগে। আর এই ৩৮ বছর ধরে তিনি দুই ক্র্যাচে চলেন। তাঁর বয়স এখন ৬০। কিন্তু দেখলে তা মনে হয় না। সুন্দর সৌম্য চেহারা। যুবা বয়সের সুঠাম দৈহিক গড়ন আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না।

১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর ‘খাপড়া ওয়ার্ড’-এ রাজবন্দীদের ওপর গুলি চালানোর ফলে সাতজন শহীদের সঙ্গে নূরুন্নবীও গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। পায়ে গুলি লেগেছিল। ক্ষতস্থানে ‘গ্যাংগ্রিন’ হলে পা কেটে ফেলে দিতে হয়। তারপর থেকে দুটি ক্র্যাচই তাঁর সঙ্গী, আশ্রয় আর বন্ধু। কাজ করেন একটি মাসিক কাগজে। থাকেন কলকাতার এক মেসে। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে থাকে বর্ধমানের নিজামপুর গ্রামে। সেখানেই তাঁর পৈতৃক বাসভূমি।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হলে নূরুন্নবী নিজের ইচ্ছায় সরকারি চাকরি নিয়ে তত্কালীন পূর্ববাংলায় চলে এসেছিলেন। খুলনায় সিভিল সাপ্লাই অফিসের চাকরিতে যোগ দেন। গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়ে এই নতুন দেশটি গড়ার লক্ষ্যে তিনি এ সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেদিন। সে সময় আরও অনেকেই এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে পূর্ববাংলায় এসেছিলেন। অনেকে চরম অত্যাচার, নির্যাতন আর সীমাহীন দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও এ দেশে থেকে গেছেন মাটির টানে, আদর্শের জোরে।

নূরুন্নবী ১৯৪৭ সালেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। খুলনায় প্রথমে তিনি রেল শ্রমিক ইউনিয়নের গোপন সংগঠক হিসেবে রাজনীতিতে অংশ নেন। ১৯৪৮ সালের ৯ মার্চের রেল ধর্মঘটের পর তিনি আকস্মিকভাবে গ্রেপ্তার হয়ে যান। প্রায় এক বছর খুলনা জেলে থাকার পর নূরুন্নবীকে ১৯৪৯ সালের মে মাসে রাজশাহী জেলে পাঠানো হয়। সেখানে খাপড়া ওয়ার্ডে-এ তিনি জায়গা পান। তখন রাজশাহী জেলে দেশের বিভিন্ন স্থানের নানা বয়সের প্রায় ৩৯ জন রাজবন্দী ছিলেন।

সে সময়টায় বামপন্থী ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে তুমুল তর্কবিতর্ক চলছে। কৌশল হিসেবে গৃহীত হয়েছিল এক চরম হঠকারী নীতি। সে জন্য সমস্যা-সংকটের অন্ত ছিল না। রাজবন্দীদের জেলজীবনও এসব থেকে বাইরে ছিল না। পাকিস্তান নামের নতুন কৃত্রিম রাষ্ট্রের শাসন পরিচালনার ভার যাদের ওপর ন্যস্ত হয়েছিল, সেই প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ সরকারের শাসন-শোষণ আর অত্যাচারও চরমে উঠেছিল। শুরু থেকেই এ দেশের যেকোনো গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনকে নির্মূল করতে সচেষ্ট ছিলেন তাঁরা। আর সে জন্য দেশের সব কটি কারাগার ছিল বিনা বিচারে আটক শত শত রাজবন্দীতে পূর্ণ।

জেলে রাজবন্দীদের দুর্দশার শেষ ছিল না। সাধারণ কয়েদিদের মতো একই ব্যবস্থা ছিল তাঁদের। ব্রিটিশ শাসনামলে বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত রাজবন্দীদের সুযোগ-সুবিধাগুলোও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সে জন্য রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে বিশেষ মর্যাদা ও তদনুযায়ী খাদ্য, পরিধেয়, পড়াশোনার ব্যবস্থার জন্য ঢাকা ও রাজশাহীর রাজবন্দীরা ১৯৪৯ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চারবারে মোট ১৫০ দিনের মতো অনশন ধর্মঘট করেছিলেন।

এসব অনশন-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজবন্দীদের কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায় হলেও বহু প্রতিশ্রুতি কর্তৃপক্ষ রাখেনি।

সে সময় রাজশাহী জেলের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বিশেষ করে কয়েদিদের সঙ্গে পাশবিক আচরণ করা হতো। এমনকি তাঁদের দিয়ে ঘানি পর্যন্ত টানানো হতো। খাদ্য দেওয়া হতো মানুষের অযোগ্য। ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে এসব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ কয়েদিরা অনশন ধর্মঘট করেছিল। রাজশাহী জেলের রাজবন্দীরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।

অনশন ধর্মঘটের কয়েক দিনের মধ্যেই জেল কর্তৃপক্ষ কয়েদিদের ঘানি টানানো বন্ধ ও উন্নত খাদ্য সরবরাহের দাবি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু রাজবন্দীদের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিল। দাবিদাওয়া, অনশন ধর্মঘট প্রভৃতি নিয়ে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডের রাজবন্দী আর জেল কর্তৃপক্ষের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটছিল। কর্তৃপক্ষ রাজবন্দীদের ব্যাপারে কিছু ব্যবস্থা, বিশেষ করে খাপড়া ওয়ার্ড থেকে ১০ জন নেতৃস্থানীয় রাজবন্দীকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাজবন্দীরা এ সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকার করেন।

এ রকম একটা উত্তেজনাপূর্ণ পটভূমিতে ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে, কোনো বিপদ সংকেত ছাড়াই খাপড়া ওয়ার্ডের চারদিক থেকে ২০টি বড় বড় জানালা দিয়ে ব্যাপক গুলিবর্ষণ করা হয়। গুলিবর্ষণের পর বর্বরভাবে লাঠিপেটা করা হয় আহতদের। পুলিশের গুলিতে সাতজন রাজবন্দী—বিজন সেন, দেলোয়ার হোসেন, হানিফ শেখ, কম্পরাম সিংহ, সুখেন্দু ভট্টাচার্য, সুধীন ধর ও আনোয়ার হোসেন—নিহত হন। প্রায় ৪২ জন রাজবন্দীর কয়েকজন ছাড়া সবাই আহত হন। রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডের নৃশংস বর্বরতা নিয়ে দেশের বহু পত্রপত্রিকায় অনেক লেখা হয়েছে।

গুরুতর আহতদের মধ্যে ছিলেন নূরুন্নবী। বিলম্বে হলেও ২৪ এপ্রিলের সন্ধ্যায় গুরুতর আহত আরো তিনজনের সঙ্গে নূরুন্নবীকে রাজশাহী সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে হাসপাতালে তাদের রাখেনি। আহতদের আবার খাপড়া ওয়ার্ডে নিয়ে আসে। পরের দিন জেল হাসপাতালে আবার নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। ইতিমধ্যে নূরুন্নবীর ক্ষতস্থান বিষাক্ত হয়ে পড়ে। তাঁকে আবার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি পা কাটতে দেবেন না বলে ফেরত চলে আসেন। অন্যান্য রাজবন্দী, বিশেষ করে মনসুর হাবিব তাঁকে বুঝিয়ে আবার সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানেই তাঁর অপারেশন হয়। প্রায় তিন সপ্তাহ পর সেখান থেকে আবার জেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় নূরুন্নবীকে।

প্রথমে অপারেশনে আপত্তির ব্যাপারে নূরুন্নবী আমাকে বলেন, ‘আমি ভাবছিলাম, পা চলে গেলে বেঁচে কী হবে? কাজ করতে পারব না। জীবনের কী সার্থকতা?’

১৯৫১ সালের মাঝামাঝি নূরুন্নবীকে খুলনা জেলে বদলি করা হয়েছিল। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, রাষ্ট্রবিরোধী তত্পরতায় জড়িত থাকার অভিযোগের বিচারের জন্যই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। খুলনা জেলের ভেতরেই বিচার হয়। রাজশাহীর বদ্ধ প্রকোষ্ঠে পুলিশের গুলিতে এক পা হারানো নূরুন্নবীকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এবং এ সাজা ভোগ করার জন্য তাঁকে আবার সেই রাজশাহী কারাগারেই পাঠানো হয়।

রাজশাহী জেল হাসপাতালের একাকী দিন ও রাতগুলোতে নূরুন্নবী বারবার ভেবেছেন, এ প্রশ্ন তাঁর মনে জেগেছে: ‘বেঁচে কী লাভ? পা গেলে জীবনের কী সার্থকতা?’ তিনি বলেন, ‘এ রকম অবস্থায় বেঁচে থাকতে আমার ঘেন্না লাগতে শুরু করে।’

এমনি একসময়ে বাইরে থেকে কোনো এক সঙ্গী একটি বই পাঠায়, বরিস পলেভয়ের ‘স্টোরি অব এ রিয়েল ম্যান’। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের’ মডেল হিসেবে নন্দিত এ উপন্যাসটি এক কোটি কপি বিক্রি হয়েছিল। নির্মিত হয়েছিল জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ও অপেরা। পেশায় সাংবাদিক বরিস পলেভয়ই (১৯০৮-১৯৮১) এ উপন্যাসের আলোকে মারেমেইয়েভ নামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক অসম সাহসী বৈমানিক-যোদ্ধার  অসাধারণ বীরত্বগাঁথা চিত্রিত করেন। যুদ্ধে যাঁর দুই পা-ই চলে গিয়েছিল। এবং পরে কৃত্রিম পা নিয়ে তিনি আবার তাঁর বৈমানিকের পেশাতেই ফিরে গিয়েছিলেন। কঠোর পরিশ্রম আর অসমসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে আবার যুদ্ধবিমান চালিয়েছিলেন তিনি।

নূরুন্নবী বলেন, ‘ইংরেজিতে লেখা ওই বইটা আমি পড়ে ফেলি গোগ্রাসে। বারবার পড়ি। যতবার পড়ি তত বেশি বাঁচার আশা ফিরে পেতে থাকি। এ বইটি আমি সব সময় সঙ্গে রাখতাম। আর ভাবতাম, প্রস্তুতি নিতাম, যাতে ভবিষ্যতে আবার আমার কাজেই ফিরে যেতে পারি। এই বই পড়ে সাহস ফিরে পেলাম। জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেতে শুরু করলাম। এ বইটা আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।’

১৯৫৩ সালের এপ্রিলে নূরুন্নবী মুক্তি পেলেন। রাজশাহী থেকে তিনি সরাসরি চলে আসেন, তাঁর জন্য এক অজানা শহর, ঢাকাতে। এখানেই থেকে গেলেন অন্যদের সঙ্গে এবং রাজনৈতিক কাজে সক্রিয় হয়ে উঠলেন।

কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে নূরুন্নবীকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর তিনি ঢাকা জেল থেকে মুক্তি পান।

সেবার নূরুন্নবী অন্য রাজবন্দীদের চেয়ে কিছুটা আগে মুক্তি পেয়েছিলেন। তার কারণ ছিল তত্কালীন জেলবন্দী ঢাকার প্রখ্যাত মতি সর্দারের বিশেষ প্রচেষ্টা। ’৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গেলে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল।

মতি সর্দার প্রথম যখন জানলেন যে নূরুন্নবীর এক পা গেছে রাজশাহী জেলে, তারপর আবার জেলে এসেছেন, তখন তাঁকে জড়িয়ে ধরে তিনি কাঁদতে থাকেন। তার পর থেকে মতি সর্দার নূরুন্নবীকে একজন বড় মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করতেন সব সময়।

নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে মতি সর্দার দ্রুত মুক্তি লাভ করেন এবং তার চেষ্টাতেই নূরুন্নবী সবার আগে ছাড়া পেয়ে যান। মুক্তি পাওয়ার দিন, মতি সর্দার গাড়ি নিয়ে জেলগেটে এসেছিলেন। পরে মাঝে মধ্যে তাঁর বাসায় নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতেন নূরুন্নবীকে।

যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নূরুন্নবী আবার সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু ইসকান্দার মির্জা যখন পূর্ববাংলার গভর্নর তখন তিনি চিকিত্সা, বিশেষ করে কাঁধে একটি অপারেশনের জন্য কলকাতা যান। খাপড়া ওয়ার্ডে গুলির পর লাঠিপেটায় তার কাঁধের একটি হাড় ভেঙে গিয়েছিল। হাসপাতালে অপারেশন হয়। সুস্থ হয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় নেয়। এর কিছুদিন পর সারা পাকিস্তানে মার্শাল ল জারি হয়। নূরুন্নবীকে বন্ধুরা ঢাকায় ফিরতে মানা করেন। তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। দিন চলে যায়। বন্ধুদের সাহায্যে কোনো রকমে সাধারণ কাজ করে জীবন চলে তাঁর। তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। যদি আবার ফিরে যেতে পারেন তাঁর রাজনৈতিক কর্মস্থলে—পূর্ববাংলায়।

নূরুন্নবী বলেন, ‘আমার মন পড়ে ছিল বাংলাদেশে, সেখানে থাকলে সবাই আমাকে জানত। এখানে আমার কী পরিচয়, কী ভূমিকা? সে জন্য আমি বহুদিন অপেক্ষা করেছি, সুযোগ পেলেই আবার চলে যাব। সে জন্য স্থায়ী সংসারে যাইনি ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। এক বিশেষ পারিবারিক অবস্থায় আমি বিয়ে করি।

‘আমার মধ্যে এক বিরাট দ্বন্দ্ব রয়েছে। যে দেশের জন্য আমি এত কষ্ট স্বীকার করলাম, আমি সেখানে থাকতে পারলাম না। আমি কোনো কাজে আসতে পারলাম না। সেটাই সবচেয়ে বড় দুঃখ। এ চিন্তা আমাকে সব সময় কুরে কুরে খায়।

‘এখানে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, কেন এমন হলো? তখনই বিপদে পড়ে যাই। পরিচয় দেওয়া যায় না। বাংলাদেশে বললে এক কথাতেই বুঝে যেত। এমনকি, আমার ছেলেমেয়েদেরও বোঝাতে পারি না এখানে আমার কোনো পরিচয় নেই।

‘আমি এখনো নিজেকে বাংলাদেশের সংগ্রামের সঙ্গী বলে মনে করি। আন্দোলনের বিজয়ে খুশি হই। ব্যর্থতায় কষ্ট পাই। বাংলাদেশের জন্য আমার গর্ব হয়।’

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় নূরুন্নবী যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেষ্টা করেছেন। পুরোনো বন্ধুদের সহযোগিতা দিয়েছেন। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ভালো লেগেছে তাঁর।

স্ত্রী জোহরা খাতুন আর দুই কন্যা ও এক পুত্রসন্তান নিয়ে নূরুন্নবীর সংসার। তাঁরা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। দু-তিন মাসের মধ্যে নূরুন্নবী চাকরি থেকে অবসর হয়ে যাবে। তখন তিনিও কলকাতা ছেড়ে চলে যাবেন বর্ধমানের নিজামপুর গ্রামে। অবসর জীবন যাপন করবেন। কিন্তু সত্যি কি অবসরের শান্তি পাবেন তিনি? মন পড়ে থাকবে অন্যত্র, চোখের সামনে ভেসে উঠবে প্রায় ৪০ বছর আগের কোনো এক দিন, রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডের কোনো এক সকালের ঘটনাবলি। মনে পড়ে যাবে, উন্মত্ত গুলিতে বন্ধু আনোয়ারের উড়ে যাওয়া রক্তাক্ত মুখমণ্ডল। কী করে তিনি ভুলবেন কম্পরাম সিংহকে? জেল হাসপাতালে তাঁর পাশের শয্যায় রক্ত ঝরতে ঝরতে মৃত্যু হলো কম্পরাম সিংহের। একজন সত্যিকার মহান হূদয়ের মানুষ বিজন সেনের স্মৃতি আজও বড় উজ্জ্বল নূরুন্নবীর মনের ভেতর।

সেদিন নূরুন্নবীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য যখন উঠে দাঁড়ালাম, তখন আবার সেই ঈষৎ কম্পন। বেদনাহত মনে শক্ত হাতে তাঁর হাত ধরে যখন বিদায় নিচ্ছি, তখন দুই ক্র্যাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বলছেন, ‘আমৃত্যু আদর্শের প্রতি অবিচল থাকব। বাংলাদেশের মানুষের সকল প্রয়াসের প্রতি আমার অফুরান শ্রদ্ধা।’

নূরুন্নবীকে সেদিন সন্ধ্যায় শেষ কথা কী বলেছিলাম, সেটা এখন মনে নেই। আসলে, অর্থবোধক কিছুই বলতে পারিনি। ট্রামের জন্য হাঁটতে হাঁটতে পেছন ফিরেও তাকাতে পারিনি। কেন পারিনি? এমন সত্য, এমন বাস্তব ‘স্টোরি অব এ রিয়েল ম্যানের’ সামনে দাঁড়িয়ে কী বলতে পারি?