জীবন ও ভাবনা: কী করে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছালাম?

শুধু ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে গেলাম? বিষয়টা এত সহজ–সরল ছিল না। সেই ’৬২ থেকে ’৭১ পর্যন্ত লড়াই-সংগ্রামে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ লেখক, শ্রেষ্ঠ গায়ক, শ্রেষ্ঠ শিল্পী, শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী, শ্রেষ্ঠ অধ্যাপকেরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। হয়তো অত সুনাম বা অত সেরা নন, সারা বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে ছাত্র, তরুণ, স্কুল–কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক যাঁরা ছিলেন, সবাই এক কাতারে, এক ভাবনা-চেতনায় বাংলাদেশের রাজনীতির সকল আন্দোলনের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। কেউ সাংবাদিকতা করেছেন, কেউ গান করেছেন, কেউ কবিতা লিখেছেন, কেউ গল্প লিখেছেন বা ছবি এঁকেছেন। সেই উত্তাল দিনগুলোতে সেই রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে প্রতিটি সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের ধারা যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের মহান একটা গতিধারা তৈরি হয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তো বটেই, তার দুই বছর আগে আমরা যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম, আসলে পুরো দশকজুড়েই সে-সময়ের প্রতিটি ছাত্র আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাহিত্য আন্দোলনে অংশ নিতাম। একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন প্রকাশ করতাম। তখন ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তার সকল অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম, বিভিন্ন পর্যায়ে সামাজিক আন্দোলন, সাহিত্যিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন, রাজনীতির আন্দোলন—সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

১৯৬২ সাল থেকে আমরা সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলাম। ভেতরে-ভেতরে গোপনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও সংযুক্ত ছিলাম। সেই সময়ের আন্দোলনের শুরুর দিক থেকে একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একটা বড় আন্দোলন গড়ে তুলছিল, তেমনি বামপন্থী সংগঠনগুলোও গোপনে বা প্রকাশ্যে সেই আন্দোলনকে অব্যাহতভাবে শক্তিশালী করেছে। স্বাধিকার চেতনার সেই আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের অনেককে নির্যাতিতও হতে হয়েছে। নেতা-কর্মীদের কারাবরণও করতে হয়েছে। তবু তাঁরা একইভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রমও চালিয়ে গেছেন।

১৯৬২ সাল থেকে ’৭০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সারা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজে কখনো সারা দেশের সকল নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন বিজয়ী হয়েছে, কখনো ছাত্রলীগ বিজয়ী হয়েছে। একই রকম বা একটু বেশি সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের বিপুল সদস্য সেই সব আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। আবার বলা যায়, সেই সময় যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সংগীত নিয়ে যে কাজ, গানের অনুষ্ঠান, কবিতার অনুষ্ঠান আয়োজন ও সংকলন প্রকাশ—সব বিষয়ে আমাদের ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ, আমাদের বামপন্থীদের পরিচালিত সংগঠনগুলো অনেক বেশি সক্রিয় ছিল।

সেই সময় উৎসাহের সঙ্গে আমরা যেমন মিছিল-মিটিংয়ে হাজির থেকেছি, তেমনি আমরা পোস্টার করেছি, দেয়ালে-দেয়ালে স্লোগান লিখেছি। ঠিক একইভাবে আমরা কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। একইভাবে গানের অনুষ্ঠানের সফল আয়োজন সম্পন্ন করেছি। কখনো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট কখনো বাংলা একাডেমির বটতলার বিশাল ময়দানজুড়ে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে সেই অনুষ্ঠানগুলো হতো।

এখনো মনে আছে, ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম ছাত্র ইউনিয়নের একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল পদক্ষেপ নামে। তারপর ধারাবাহিকভাবে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে প্রতিধ্বনি (১৯৬৪), বিক্ষোভ (১৯৬৫), ঝড়ের খেয়া (১৯৬৬), সূর্যজ্বালা (১৯৬৭), অরণি (১৯৬৮), নিনাদ (১৯৬৯) ইত্যাদি নামে সংস্কৃতি সংসদ থেকে একুশে সংকলন প্রকাশ করেছি। সে-সময় এগুলো শ্রেষ্ঠ সংকলন বলে স্বীকৃত ছিল। প্রায় প্রতিটি সংকলন প্রকাশের সঙ্গে আমার ছিল সক্রিয় সম্পৃক্ততা।

ছাত্র ইউনিয়ন প্রকাশ্যভাবে প্রথম সম্মেলন করে ১৯৬৩ সালে কাপ্তানবাজারের রেলওয়ে ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। সেখানে সম্মেলন হয়েছিল। ইত্তেফাক–এর সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) প্রধান অতিথির বক্তৃতা দিয়েছিলেন। দুদিনের সম্মেলন শেষে বাংলা একাডেমির বটতলায় দেশাত্মবোধক গানের একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। সে অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন শেখ লুৎফর রহমান, আবদুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, সুখেন্দু চক্রবর্তী, জাহেদুর রহীম, ফাহমিদা খাতুন, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী প্রমুখ শিল্পী। তাঁরা ছিলেন সে সময়ের সেরা সংগীতশিল্পী। সে অনুষ্ঠানের স্মৃতি এখনো আমাকে অনু[প্রাণিত করে।

১৯৬৭ সালে পল্টন ময়দানে দুদিন ধরে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৫০তম বার্ষিকীর বিরাট অনুষ্ঠান হয়েছিল। শহীদুল্লা কায়সার ও আলতাফ মাহমুদ এই অনুষ্ঠানের সবকিছু করেছিলেন। বন্ধু আবুল হাসনাতের বড়ো ভূমিকা ছিল।

১৯৬৯ সালের গণভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন আর তারপর ১৯৭১ সাল। এই সময়ে ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এই সকল ঐতিহাসিক আন্দোলনে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত থেকেছি পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। কাজ করেছি সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ৮ মাস পার্টির কর্মপরিকল্পনা অনুসারে আগরতলায় থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজ করে গেছি।   

আমি রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি ১৯৯১ সালে। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, কেন? এ নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু মনের ভেতর থেকে সেই প্রথম ভালোবাসা চলে যায় না। পরে বিভক্তি, বিচ্ছেদ বা যত দুঃখ–বেদনার মধ্য দিয়ে আমাদের এই অবস্থানের পরিবর্তন হোক না কেন, একটা ভালোবাসা থেকেই যায়। আমি দল ছেড়ে দেওয়ার পর আমার সেই পার্টি অনেকভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কোনো বিভক্তি বা কোনো গ্রুপ–পাল্টা গ্রুপ কিংবা নব্য দলে যোগ দিইনি। আমি সবাইকে বলি, মাই ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট পার্টি ইজ সিপিবি। এখনো আমি চর্চা করি সবচেয়ে বেশি, হোয়াই গর্বাচেভ হ্যাপেন্ড—কেন সমাজতন্ত্র ভেঙে গেল? কেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটল? কেন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র টিকে থাকতে পারল না? কেন আরও অন্য দেশগুলো এই পথে অগ্রসর হয়ে, ব্যর্থ হয়ে চুরমার হয়ে গেল? পূর্ব ইউরোপ বলি, ইথিওপিয়া বলি, সোমালিয়া বলি—নানা দেশের কথা বলতে পারি। চীন ও ভিয়েতনামে সমাজতন্ত্র আছে। কতটুকু সমাজতন্ত্র, কতটুকু ধনতন্ত্র—এই নিয়ে বিতর্কের তো কোনো শেষ নেই। কিউবার চেষ্টা অব্যাহত আছে। দেখি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।

  • ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট সিলেট শুভানুধ্যায়ীদের আয়োজনে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে অংশবিশেষ। বক্তৃতাটির শ্রুতলিখন কিছু পরিমার্জনাসহ প্রকাশিত হয়েছিল আবুল হাসনাত সম্পাদিত শিল্প–সাহিত্যের মাসিক পত্রিকা ‘কালি ও কলম’–এ।