জীবন ও ভাবনা: যে গান গাওয়া হতো

এখানে আমি একটা কথা বলে ফেলি, সেই ’৬২-৬৩ থেকে ১৯৭০-৭১ সাল পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের হোক বা সাংস্কৃতিক সংসদের হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কোনো অনুষ্ঠানেই গণসংগীত ও দেশাত্মবোধক গানের বাইরে অন্য কোনো গান আমরা করিনি। আমাদের দেশের সেরা গণসংগীতশিল্পীরা এসব অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। যদি আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম বা অন্য কারও গানও করে থাকি, সেখানেও দেশের গান গেয়েছেন আমাদের প্রিয় শিল্পীরা। অর্থাৎ ’৬২ থেকে ’৭০-৭১ সাল পর্যন্ত আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সংগীতের ধারাতে দেশের গান এবং গণসংগীতই ছিল প্রধান। এ প্রসঙ্গে সলিল চৌধুরীর কথা আমাদের মনে পড়ে যায়। আপনারা জানেন, তিনি ছিলেন কলকাতা ও মুম্বাইয়ের সেই সময়ের দারুণ গান রচয়িতা, সুরকার ও গায়ক। সেই চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষজুড়ে সেরা গানগুলো তাঁর লেখা, তাঁর সুরে গাওয়া। সেই গানগুলো এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়। গণসংগীতের পাশাপাশি সেই দশকেই কিন্তু আমাদের সেই সংস্কৃতি সংসদ থেকে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাসের দেশ নাটক করেছিলাম ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটে। রক্তকরবী করেছিলাম ১৯৭০ সালে। এখনো আমি মনে করি, সেটি ছিল সেরা অনুষ্ঠান। রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন গোলাম মুস্তাফা। নন্দিনী করেছিলেন কাজী তামান্না। লায়লা হাসান ও আসাদুজ্জামান নূর ছিলেন সেই অভিনয় দলের সদস্য। সংগীত পরিচালনা করেছিলেন সনজীদা খাতুন এবং ওয়াহিদুল হক। আপনারা জানেন কি না—বিদ্রোহী কবিতার একটা নতুন সুর করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। তাঁর সুরে গাওয়া সেটা একদম ভিন্ন রকম ছিল। আমাদের সুযোগ হয়েছিল সে গানটাকে নৃত্যরূপ দিয়ে সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করার। আলতামাস আহমেদ সে সময়ের সেরা নৃত্যশিল্পী ও পরিচালক, তাঁর নেতৃত্বে সেই নৃত্য অনুষ্ঠানটি হয়েছিল।

মনে পড়ে, ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাস অবলম্বনে নাটক হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান–সোভিয়েত মৈত্রীর উদ্যোগে। সেটার পরিচালক ছিলেন হাসান ইমাম। নায়ক পাভেল হয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন। মা হয়েছিলেন রওশন জামিল। ছিলেন আলতাফ হোসেন, সুলতানা কামাল। সেরা সব অভিনয়শিল্পী—তখনো সেরা, এখনো সেরা।

সে সময় (১৯৬৯- ৭০) আমাদের সংকলন প্রকাশনা, মঞ্চ সাজানো, আমাদের কার্ড তৈরি করা বা আমন্ত্রণপত্র তৈরি করা ইত্যাদি কাজের জন্য আমরা যেতাম শিল্পী কামরুল হাসান, কাইউম চৌধুরী, আবদুল মুকতাদির, নিতুন কুন্ডু, দেবদাস চক্রবর্তী, প্রাণেশ কুমার মণ্ডল প্রমুখের কাছে। আমরা আন্দোলনের একটা বড় পর্যায়ে ১৯৬৯ ও ৭০ সালে শহীদ মিনারের সামনে বড় বড় দেয়ালজুড়ে ১৪টি বা ১৬টি চিত্রকর্মের প্রদর্শনী করতাম। সেখানে থাকত বায়ান্ন থেকে সত্তর পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলনের ঘটনাবলিকে অবলম্বন করে বড়ো বড়ো চিত্রকর্ম। এ আয়োজনে বড় বড় ছবি আঁকতেন শিল্পী ইমদাদ হোসেন, কাইউম চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু, মুস্তাফা মনোয়ার, রফিকুন নবীসহ আরও অনেক তরুণ শিল্পী। ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে সত্তর সালের প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেছিলেন শহীদ মতিউরের পিতা আজাহার আলী মল্লিক। আপনারা দেখুন, কী বৃহত্তর পরিসরে সে সময়ের আমাদের ছাত্র আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ লেখক, শিল্পী, কবি, গায়ক ও অভিনেতাদের আমরা যুক্ত করতে পেরেছিলাম। বহুজনের মিলিত প্রচেষ্টাতেই কিন্তু এই বিশাল এবং বড় বড় আন্দোলন ও সংগ্রামগুলো হয়েছে। এখনো পেছন ফিরে তাকালে আমরা উত্তাল তরঙ্গমালার সেই সময়কে পরিষ্কার দেখতে পাই। একদিকে সরাসরি রাজনৈতিক আন্দোলন, তার পাশাপাশি সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাটক, গান, সিনেমা সবকিছুর মধ্য দিয়ে একটা মহামিলনের স্রোতোধারা গিয়ে মিলেছিল মুক্তিযুদ্ধে—একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে। এটা একটা ঐতিহাসিক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা যে, দেশের সকল ধর্ম ও গোষ্ঠীর মানুষ স্বাধীনতাসংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলেন। এই বিপুল স্রোতোধারার সঙ্গে, তার পেছনে, তার সামনে আমরাও ছিলাম। এসব মহা কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে আমার জীবনের, আমার পছন্দের, ভালো লাগার, ভালোবাসার, আমার সবচেয়ে অনুপ্রেরণাকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

  • ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট সিলেট শুভানুধ্যায়ীদের আয়োজনে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে অংশবিশেষ। বক্তৃতাটির শ্রুতলিখন কিছু পরিমার্জনাসহ প্রকাশিত হয়েছিল আবুল হাসনাত সম্পাদিত শিল্প–সাহিত্যের মাসিক পত্রিকা ‘কালি ও কলম’–এ।